তিন পার্বত্য জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ- কোন ভিন্নতর উদ্দেশ্য রয়েছে কি?     

0

বিশেষ প্রতিবেদক: গত ১০ জুন দৈনিক নয়াদিগন্ত নামক সাম্প্রদায়িক ভাবাপুষ্ট পত্রিকায় ’শিগগিরই ১৮ জেলায় নতুন ডিসি’ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে শিরোনামে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট একটি খবর প্রথম পাতায় খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। (http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/126275#sthash.El5q9jJs.dpuf) এতে বলা হয়েছে, আগামী ২৬-২৮ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আগেই দেশের ১৮ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। এসব জেলায় যারা তিন বছর বা তার কাছাকাছি সময় ধরে অবস্থান করছেন এবং যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় রয়েছেন তাদের প্রত্যাহার করে আগামী সপ্তাহ নাগাদ এ নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

Muktomot copy2এই পত্রিকার রিপোর্টে ১৮টি জেলা ও জেলা প্রশাসকদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে বলা হয় যে, তাদেরকে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনের আাগেই ‘প্রত্যাহার করা হতে পারে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত ১৮টি জেলার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার জেলা প্রশাসকদের নাম উল্লেখ করে তাদেরও প্রত্যাহার করা হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, দেশের বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ঘেঁটে দেখা গেছে এই খবরটি আর অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

এখন দেশের আরও বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত না হয়ে ডানপন্থী ভাবাদর্শীয় ও সাম্প্রদায়িক মনস্ক ও একইসাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ ও লালনকারী একটি পত্রিকায় সরকারের ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি সাদাচোখে দেখার অবকাশ নেই।

এখানে বলা প্রয়োজন নয়াদিগন্ত নামক পত্রিকাটি সদাসর্বদা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উগ্রবাদী খবরাদি প্রকাশ করে থাকে। পত্রিকার ১১ জুন সংখ্যায় ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠার সম্পাদকীয় এক কলামের শিরোনাম দেয়া হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অচল করার হুমকি সন্তু লারমার- বিশেষ নজর রাখতে হবে পাহাড়ি অঞ্চলে’।

সম্পাদকীয় কলামের বক্তব্য খুবই কৌশলীভাবে প্রদান করা হয়। এতে একইসাথে বলা হয়- ‘দীর্ঘ ১৮ বছরেও সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। উল্টো অপারেশন উত্তরণের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন বলবৎ রেখেছে’ । কিন্তু সেনাশাসন জারি না রেখে দেশের অন্য অঞ্চলের মতো গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি না করে বরং সম্পাদকীয় কলামের শেষের দিকে বলা হয়, ‘কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বা হানাহানির সুযোগ নিয়ে সেখানে অনাকাঙ্খিত কোনো অবস্থা সৃষ্টির ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ নজর রাখতে হবে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর। তা না হলে বড় কোন বিপত্তি দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়।’

এই বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে পত্রিকাটি এই কথাটিই বলতে চেয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ ‘নিরাপত্তা নজরদারী’র মধ্যে রাখতে হবে। সুতরাং, পত্রিকাটি সরাসরি ‘সেনাশাসন জারি’ রাখার কথা না বললেও আকারে ইঙ্গিতে যে সেখানে মানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন বজায় রাখা প্রয়োজন এই কথাটিই বলতে চেয়েছে।

এখানে বলা প্রয়োজন, সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ সচেতন জনগণের মুখে মুখে স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কিত একটি কথা শোনা যাচ্ছে। আর তা হলো, বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় সেনা কর্তৃত্ব নির্ভর বা সেনা প্রভাবিত প্রশাসন পরিচালিত হবে, নাকি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো গণতান্ত্রিক প্রশাসন পরিচালিত হবে তা নিয়ে পার্বত্য তিন জেলার প্রশাসনিক ও সামরিক কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা য্দ্ধু চলছে। এ বিষয়ে বলা যেতে পারে গত ৮ মে রোববার ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ভিত্তি ফলক উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ে চারটি ক্যান্টনমেন্টে তাদের রাখা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়ার কথা বললেও সেনা শাসন অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার করা হবে কি না সে ব্যাপারে কিছুই বলেননি। এছাড়া তিনি যে ঘোষণা দিয়েছেন তা আদতেই বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও পার্বত্যবাসীর মনে সংশয় ও সন্দেহ রয়েছে। এই সংশয় ও সন্দেহ আরো ঘনীভুত হতে শুরু করেছে গুইমারার নতুন ব্রিগেড কমান্ডারের সাম্প্রতিক বক্তব্যের পর। সিএইচটিনিউজ.কম এ গত ৬ জুন ’গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডারের বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে- ’ প্রধানমন্ত্রী আর্মিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এমন ঘোষণা দিলেও আর্মিরা কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাবে না।’ (https://chtnews.com/wp/%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%87%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%A6%BF%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%A1-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E %E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E00%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%BE-2/)

গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডার যদি এই কথা বলে না থাকেন তবে সিএইচটিনিউজ.কম এ প্রকাশিত এই প্রতিবেদন বিষয়ে তাঁর প্রতিবাদ জানানো নিশ্চয়ই প্রয়োজন রয়েছে। তিনি এখনো কোনো ধরনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বলে সিএইচটিনিউজ.কম অবগত নয়। সুতরাং, এটা বলা যায় যে, তিনি প্রতিবেদন মতে গণমান্য ব্যক্তিদের সাথে মতবিনিময় সভায় এই কথাটি বলেছেন। আর তাঁর মতো দায়িত্ববান সামরিক একজন অফিসারের কাছ থেকে এই বক্তব্য প্রদানের তাৎপর্য নিশ্চয়ই রয়েছে। তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে দেশের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন বার্তা দিতে চেয়েছেন কীনা তা আমাদের বোধগম্য নয়। সবার জানা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকার প্রধানের কথাই হলো শেষ কথা। তার উপর অন্য কারোর কথা থাকতে পারে না। সরকারী সিদ্ধান্ত অমান্য করার এক্তিয়ার সেনাবাহিনীর কোন কর্মকর্তার থাকতে পারে না। সেই হিসেবে গুইমারা ব্রিগেড কমান্ডারের বক্তব্য একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল।

নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত পার্বত্য তিন জেলার জেলা প্রশাসক রদবদলের খবরটি এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তিন পার্বত্য জেলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসকদের বদলী এই দ্বন্দ্বের পরিণতির একটি দিক হতে পারে। এই অঞ্চলে সেনা কর্র্তৃত্বের আসল রূপ স্পষ্ট হয় যখন ২০০৩ সালে মহালছড়ি উপজেলায়  সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হবার পরে তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘পাহাড়িরা অসহায়, আমি নিরূপায়’। সে সময় সেটলাররা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় মহালছড়িতে পাহাড়িদের বেশ কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়েছিল। জেলা প্রশাসক পাহাড়িদের বিরুদ্ধে এত বড় অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর প্রতিকার করতে চাইলে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি উক্ত মন্তব্য করেছিলেন।

———————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More