দিঘীনালায় বিজিবি সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন না করার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে এলাকাবাসীর আবেদন

0

সিএইচটিনিউজ.কম ডেস্ক:
খাগড়াছড়ির দিঘীনালা উপজেলার ৫১নং দীঘিনালা মৌজার যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় হতদরিদ্র পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বিজিবি সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন না করার দাবি জানিয়ে এলাকাবাসী গতকাল ২৭ মে মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। এতে হাইকোর্টের রিট আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা সহ ৪ দফা দাবি জানিয়েছেন তারা। সিএইচটিনিউজ.কমের পাঠকদের জন্য আমরা এলাকাবাসীর দাখিল করা আবেদনপত্রের বিস্তারিত এখানে প্রকাশ করছি:

————-

বরাবর,
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
সেগুন বাগিছা, ঢাকা, বাংলাদেশ।

বিষয়: দিঘীনালার যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় হতদরিদ্র পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন না করার আবেদন।

তারিখ: ২৭ মে ২০১৪, মঙ্গলবার।

মাধ্যম: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, দীঘিনালা উপজেলা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।

মহোদয়,
সবিনয় বিনীত নিবেদন এই যে, আমরা নিম্ন আবেদনকারীগণ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলার ৫১ নং দীঘিনালা মৌজার স্থায়ী অধিবাসী হই। উপরোক্ত ঠিকানায় আমরা বংশ পরম্পরায় পরিবার পরিজন নিয়ে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছি। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, গত ২০০৫ সাল থেকে উক্ত জমিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তার একটি সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে বহু দরিদ্র পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ কারণে সে সময় এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন (মামলা 01(1)নং-৩৪৫৫/২০০৫) পেশ করা হয়। মহামান্য আদালত ১৯ মে ২০০৫ বিজিবির (তখন বিডিআর) হেডকোয়ার্টার স্থাপনের জমি অধিগ্রহণের জন্য জারিকৃত নোটিশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে সরকারের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন এবং এই রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত নোটিশের কার্যকারীতা স্থগিতের নির্দেশ দেন। অথচ এই রিট আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকার পরও বিজিবি সদস্যরা গত ১৪ মে ২০১৪ ইং গভীর রাতে উক্ত জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং সেই পর থেকে তারা সেখানে অবস্থান করছে, যা সুস্পষ্ট আদালত অবমাননা বলে আমরা মনে করি। আমরা নিুলিখিত কারণে বাবুছড়ার যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপন না করার জন্য মহোদয়ের সমীপে আর্জি জানাচ্ছি।02

১। বাবুছড়ার যেখানে বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে তার পশ্চিমে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে সেনাবাহিনীর বাবুছড়া সাবজোন। এছাড়া রয়েছে উত্তরে জারুলছড়ি আর্মি ক্যাম্প ও নারেইছড়ি বিজিবি ক্যাম্প, দক্ষিণে কার্বারী টিলা আনসার-ব্যাটালিয়নের ক্যাম্প ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কাটারুংছড়া আর্মি ক্যাম্প। এই ক্যাম্পগুলোর অবস্থানও নারেইছড়ির বিজিবি ক্যাম্প বাদে প্রস্তাবিত বিজিবি সদর দপ্তর থেকে বেশী দূরে নয়। সর্বোপরি পাশের উপজেলা বাঘাইছড়ি ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে বিজিবির দু’টি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর রয়েছে। অতএব যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় নতুন করে বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের কোন প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা নেই।

২। উপরোক্ত বাবুছড়া সাবজোন ১৯৮৫ সালে এলাকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে জোরপূর্বক স্থাপন করা হলে সে সময় বেশ কয়েক পরিবার পাহাড়ি বাস্তুভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন করা হলে তাদের অনেককে আরও একবার উচ্ছেদের শিকার হতে হবে।

03৩। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের আইন মানা হয়নি। এই আইনের ৬৪(১-খ) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “আপাতত: বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন- ….(খ) পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সহিত আলোচনা ও উহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাইবে না।” সুতরাং বলা যায়, জেলা পরিষদের সম্মতি ছাড়া বিজিবির জন্য উক্ত জমি জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

৪। যে জায়গায় বিজিবির সদর দপ্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা একটি অত্যন্ত ঘনবসিতপূর্ণ এলাকা। এ কারণে বিজিবির ক্যাম্প স্থাপনের পূর্বে স্থানীয় জনগণ ও হেডম্যানের মতামত নেয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়, অথচ তা করা হয়নি।

৫। প্রস্তাবিত জায়গায় বিজিবির সেক্টর দপ্তর স্থাপন করা হলে বহু দরিদ্র পাহাড়ি পরিবার উচ্ছেদের শিকার হবেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার দ্বিতীয় বারের মতো উচ্ছেদ হবেন। যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাহাড়িদের কাছে খাস জমি বণ্টনের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বিজিবির একটি অপ্রয়োজনীয় সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য হতদরিদ্র পাহাড়িদের উচ্ছেদপূর্বক উদ্বাস্তুতে পরিণত করা যে কোন বিবেকবান মানুষের কাছে চরম অমানবিক বলে বিবেচিত হবে।05

৬। পূর্বেই বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে উপরোক্ত জায়গায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য প্রথম বার জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হলে তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করা হয়। এই রিট আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার আগে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বিজিবি কর্তৃক অবৈধভাবে ভূমি দখল করা সুবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বিজিবির উক্ত পদক্ষেপকে আদালত অবমাননা এবং আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ভিন্ন অন্য কিছু আখ্যায়িত করা যাবে না।

৭। উপরোল্লেখিত রিট আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বে গত ১০ এপ্রিল ২০১৪ ক্ষতিপূরণ গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় (এলএ শাখা) থেকে জেলা প্রশাসকের পক্ষে ভূমি হুকুম দখল কর্মকর্তা মো. আলী আফরোজ স্বাক্ষরে ভূমি মালিকদের নামে নোটিশ ইস্যু করা হয় (যার স্মারক নং ০৫.৪২.৪৬০০.০১৮.০১৪.০২.১৩ (অংশ-২)। তবে এখনও রিট আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি বিধায়, ভূমি মালিকদের কেউ ক্ষতিপূরণ গ্রহণে উদ্যোগী হননি। তারপরও উক্ত ক্ষতিপূরণ গ্রহণ সংক্রান্ত নোটিশের নিষ্পত্তি হওয়ার আগে সম্পূর্ণ শক্তির জোরে ভূমি অধিগ্রহণ করা কেবল অন্যায় নয়, তা দেশের প্রচলিত আইন কানুনেরও পরিপন্থি।

৮। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় বাবুছড়া বিজিবি সদর দপ্তর স্থাপন প্রকল্পের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম (ভূমি অধিগ্রহণ) প্রবিধান ১৯৫৮ অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এতে বাবুছড়া ইউনিয়নে বিজিবির সদর দপ্তর উল্লেখ করা হলেও ভূমি অধিগ্রহণ করা হয় ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ৫১ নং দীঘিনালা মৌজায়। মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে বিজিবির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ অবৈধ।

৯। ঘনবসিতপূর্ণ এলাকায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন করা হলে জনগণের জন্য বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বিজিবি সদস্যদের প্রতিদিনের কুচকাওয়াজ, টার্গেট প্রেকটিস ও সামরিক যানের আনাগোনার শব্দে এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট হবে ও শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

06(1)১০। বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের কারণে যে সব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থী। যে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির ভিত্তিতে তারা দেশে ফিরে আসেন, তার আওতায় তাদেরকে যথাযথ পুনর্বাসন না করে বরং তাদের জমি অধিগ্রহণের নামে নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত অমানবিক।

১১। বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তরের জন্য প্রস্তাবিত জমিতে ভূমি মালিকরা পরিবার পরিজন নিয়ে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছেন। ইতিমধ্যে তারা বিভিন্ন বাগান-বাগিছাও গড়ে তুলেছেন। উপরোক্ত জমি ব্যতীত তাদের আর কোথাও কোন প্রকার জমি নেই। তাই তাদেরকে উচ্ছেদ করে বিজিবি’র সেক্টর হেডকোয়ার্টার নির্মিত হলে তা তাদেরকে গলা টিপে হত্যা করার সামিল হবে।

১২। কেবল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো নয়, দীঘিনালার সর্বস্তরের মানুষ বাবুছড়ায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের বিরুদ্ধে। তার প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, গত ১৯ মে ২০১৪ এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ কয়েক হাজার নারী পুরুষ বাবুছড়ায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপন না করার দাবিতে দীঘিনালা সদরে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছেন।

অতএব, মহোদয়ের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন ও দাবি:
১। মহামান্য হাইকোর্টে রিট আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাবুছড়ার যত্ন মোহন কার্বারী পাড়ায় বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হোক।
২। প্রস্তাবিত স্থানে উক্ত সদর দপ্তর স্থাপনের পূর্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও হেডম্যান সহ বাবুছড়া এলাকার জনগণের মতামত নেয়া হোক।
৩। উপরোল্লেখিত ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীদের যথাযথ পুনর্বাসন করা হোক।
৪। বাবুছড়া আর্মি ক্যাম্প স্থাপনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক।
——————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

 

 

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More