দীঘিনালায় বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন
সিএইচটিনিউজ.কম
ঢাকা: জমির বেদখলদার বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং জেলা প্রশাসনের অবৈধ জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে জমি ফিরিয়ে দেয়া সহ ৫ দফা দাবি জানিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলাধীন দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়া এলাকার ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার ও দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটি।
আজ ৯ আগস্ট ২০১৪ শনিবার সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য প্রজ্ঞান জ্যোতি চাকমা। এ সময় ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সমর বিকাশ চাকমা ও বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদের শিকার হওয়া ২১ পরিবারের মধ্য থেকে গোপা চাকমা, অপ্সরী চাকমা, সুদর্শনা চাকমা, নতুন চন্দ্র চাকমা, মৃণাল কান্তি চাকমা ও দেবতরু চাকমা উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে প্রজ্ঞান জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘গত ১৪ মে গভীর রাত আনুমানিক ৩টায় বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা তাদের সদর দপ্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে দীঘিনালা উপজেলায় ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়নের ৫১ নং দীঘিনালা মৌজায় অবস্থিত যতœ কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়ার আওতাভুক্ত জমিতে সশস্ত্রভাবে অবস্থান নেয়। গত ১০ জুন বিকেল ৪টার দিকে গ্রামের কয়েকজন নারী তাদের জমিতে কলা গাছের চারা রোপন করতে গেলে বিজিবি সদস্যরা সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাধা দেয় এবং রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, বন্দুকের বাট ও লাঠি দিয়ে আক্রমণ করে ১৮ জনকে আহত করে। বিজিবি ঐদিনই গ্রাম থেকে আমাদের ২১ পরিবারকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে এবং ১১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১০০/১৫০ জনের বিরুদ্ধে দীঘিনালা থানায় মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে। উচ্ছেদ হওয়ার পর আমরা বাধ্য হয়ে বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই এবং আজ পর্যন্ত আমাদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি ফেরত না পাওয়ায় সেখানে অবস্থান করছি।’
বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি এলাকার জনগণের জন্য নানাবিধ সমস্যার কথা তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা পুকুরে গোসল করার সময় বিজিবি সদস্যরা তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের পুকুরে গোসল/¯œান করে। এতে আমাদের বিশেষত নারীদের প্রচুর সমস্যা হয়। বিজিবি কর্তৃক রাস্তায় চেক পোস্ট বসিয়ে আমাদের চলাচল সীমিত করা হয়েছে। রাতের বেলায় চলাফেরা ও ঘোরাফেরা করা যায় না। এর ফলে দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। তাছাড়া বিজিবি সদস্যরা এখন টহলের নামে নিয়মিত পাড়া গ্রামে যাচ্ছে। বাইরে কাজের সময় অনেকে বাড়িতে তাদের কিশোরী মেয়েদের একা রেখে যেতে বাধ্য হয়। তাই এখন সবচেয়ে মেয়েরা বেশী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সর্বোপরি অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এখানে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হলে স্থানীয় জনগণের উপর হয়রানি ও নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।’
বৌদ্ধ মন্দিরের জমিও বিজিবি অধিগ্রহণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অধিগ্রহণকৃত ২৯.৮১ একর জমির বাইরেও ১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তাদের কাঁটাতারের ঘেরার ভেতরে ঢুকানো হয়েছে ও এলাকার ভেতরে ১টি বৌদ্ধ মন্দিরের জমি রয়েছে যা দীঘিনালার ভূমি অফিসের মাঠ খসড়ার মানচিত্রে ৯৬০ নং দাগে স্পষ্টভাবে উলে¬খ রয়েছে।’
বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে প্রজ্ঞান জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘হামলা ও উচ্ছেদের পর আমরা ২১ পরিবারের ৮৪ জন এই বাবুছড়া হাইস্কুলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে আমরা স্কুলের দুইটি কক্ষে গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন যাপন করছি বললেও কম বলা হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকে এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই ৮৪ জনের মধ্যে রয়েছে ৪ জন কলেজ পড়–য়া ছাত্রী, ৯ জন হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী ও ৭ জন প্রাইমারী লেভেলের ছাত্রছাত্রী। তাদের সবার পড়াশুনা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘বিজিবি’র বাধার কারণে আমরা আমাদের বাড়িতে যেতে পারছি না। হামলার পর থেকে তারা আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমাদের বাড়িগুলোও তাদের দেয়া কাঁটাতারের বেড়ার বাউন্ডারীর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। বাড়িতে আমাদের গরু-ছাগল, হাস-মুরগী, শুকর ও ধান-চাল রয়েছে। পরণের কাপড় চোপড় পর্যন্ত আনতে দেয়া হয়নি।’
‘উচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে আমাদের চাষবাদ ও কাজ কর্ম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। অথচ এখন চাষের ভরা মৌসুম। চাষাবাদ না হলে কিভাবে জীবন চলবে, আমরা কোথায় যাবো, কবে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারবো- এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে।’
‘মামলার কারণে গ্রামের অনেকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের খোঁজে ও লোকজনের মনে ভয়ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিজিবি ও আর্মিরা নিয়মিত গ্রামে গ্রামে হানা দিচ্ছে। ফলে আমাদের ছাড়াও অনেকের স্বাভাবিক জীবন যাপন ও চাষবাস বন্ধ হয়েছে।’
‘বিজিবি হামলার পর ২ নং বাঘাইছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুলটিও বিজিবি তাদের কাঁটা তারের বাউন্ডারীর ভিতরে ঢুকিয়েছে। ফলে স্কুলের ১০৫ জন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের কারণে যে সব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা সবাই ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী শরণার্থী। যে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তির ভিত্তিতে আমরা দেশে ফিরে এসেছি, তার আওতায় আমাদেরকে যথাযথ পুনর্বাসন না করে বরং জমি অধিগ্রহণের নামে আমাদেরকে নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে বলা হয়, আমাদের দোষ কী? কেন আমাদেরকে বার বার নিজ জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে? আমরা কাপ্তাই বাঁধের কারণে গত শতকের ৬০ দশকে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে একবার উচ্ছেদ হয়েছিলাম। তারপর আমরা দীঘিনালার এই জায়গায় এসে বসতি গড়ে তুলি। তখন এই এলাকা ছিল ঘন বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত। ছিল বাঘ ভালুকসহ বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর আবাস। আমরা এই ধরনের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এলাকাটি বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। বহু কঠিন পরিশ্রম করে চাষের জমি সৃষ্টি করি। কিন্তু এখানেও আমরা সুখে থাকতে পারছি না। ৮০র দশকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে হলো। ১৯৯৮ সালে সেখান থেকে ফিরে এসে নতুনভাবে জীবন শুরু করি। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতে আবার আমাদের জমি কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র হলো এবং অবশেষে গত ১৪ মে বিজিবি জোর করে আমাদের জমি কেড়ে নিলো। আর আমরা আবার পথের ভিখেরী হয়ে গেলাম।
সংবাদ সম্মেলন থেকে তারা ৫ দফা দাবি জানিয়েছেন। দাবিগুলো হলো:
১। আমাদের জমির বেদখলদার বিজিবির ৫১ নং ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং জেলা প্রশাসনের অবৈধ জমি অধিগ্রহণ বাতিল করে আমাদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
২। গত ১০ জুনের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ও গত ৩ আগষ্ট বিজিবির দেয়া মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে; হামলার সাথে জড়িত বিজিবি, পুলিশ ও সেটলারদের গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং হামলায় আহতদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৩। বিজিবির দেয়া মামলায় গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে ও হয়রানিমূলক দায়ের করা মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৪। গ্রামে গ্রামে সেনা ও বিজিবির টহলের নামে জনগণের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ করতে হবে।
৫। বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার কারণে আমরা যারা আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছি, তাদেরকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।