দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির সংবাদ সম্মেলন, ২১ পরিবারকে নিজ জমিতে পুনর্বাসনের দাবি

0

সিএইচটিনিউজ.কম
Press conference dighinalaদীঘিনালা:  শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলার প্রতিবাদে এবং বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর অন্যত্র নির্মাণ ও উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারকে তাদের নিজ জমিতে পুনর্বাসনের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) সংবাদ সম্মেলন করেছে দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটি।

দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে (যেখানে উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবার অবস্থান করছে) সকাল সাড়ে ১১টায় এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও ৪নং দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা।

এতে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক পরিতোষ চাকমা, দীঘিনালা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সুসময় চাকমা, ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ধর্ম জ্যোতি চাকমা। এছাড়া উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলন থেকে ৫ দফা দাবি জানানো হয়। এগুলো হচ্ছে-
১. বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া-শশী মোহন কার্বারী পাড়ার পরিবর্তে এমন স্থানে নির্মাণ করতে হবে যেখানে কাউকে উচ্ছেদের শিকার হতে হবে না।
২. যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন কর্তৃক  উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারকে নিজ নিজ জমিতে ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করতে হবে।
৩. ১১ জুন ২০১৪ ও ১৫ মার্চ ২০১৫ উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের সদস্যসহ দীঘিনালাবাসীর বিরুদ্ধে দেয়া মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে।
৪. ১৫ মার্চ ২০১৫ আটককৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
৫. গ্রামে গ্রামে বাড়িঘরে তল্লাশীর নামে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলা হয়, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনসহ কোন ধরনের ভয়ভীতি জনগণের এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে না। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আগামীতে জনগণের বিভিন্ন মহলের সাথে মত বিনিময়সহ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচী অব্যাহত রাখবো। আমাদের দাবীর প্রতি দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি এবং মানবাধিকার সংগঠনের সমর্থন রয়েছে। তাদের সাথে একাত্মতা বাড়াতে কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ধর্ম জ্যোতি চাকমা।

নীচে সংবাদ সম্মেলনের পুরো বক্তব্যটি তুলে ধরা হলো: 

শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় হামলার প্রতিবাদে
এবং
বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর অন্যত্র নির্মাণ ও উচ্ছেদকৃত ২১ পরিবারকে
তাদের নিজ জমিতে পুনর্বাসনের দাবিতে

 সংবাদ সম্মেলন

১৯ মার্চ ১০১৫, বাবুছড়া, দীঘিনালা

সম্মনিত সাংবাদিক বন্ধুরা,
আপনারা আমাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আপনারা জানেন, আমরা গত ১৫ মার্চ রবিবার বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর অন্যত্র নিমার্ণ ও উচ্ছেদকৃত ভারত প্রত্যাগত ২১ পরিবারকে তাদের নিজ জমিতে পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন দাবীতে বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন অভিমুখে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রার আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু সেনাবাহিনী ও পুলিশ মাইনী ব্রিজ, নু-অ পাড়া, বানছড়া, বাবুছড়া, কার্বারী টিলা, আদর্শ স্কুলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বাধা দেয়। শুধু তাই নয়, তারা পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের উপর গুলি চালায়, লাঠিপেটা করে এবং কমপক্ষে ১২ জনকে আটক করে। পরে তাদের একজনকে ছেড়ে দেয়া হলেও বাকিদের জেলে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে লীলু চাকমা নামে এক কলেজ ছাত্রীও রয়েছেন। এছাড়া হামলাকারী পুলিশ নিজেরাই বাদী হয়ে ৫৬ জনের নামোল্লেখসহ অন্যায়ভাবে মামলা দায়ের করেছে। হামলায় আহত ৮ জনের মধ্যে ত্রিদিব চাকমা ও শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী সুবিকাশ চাকমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় বাধা দেয়া হলে আমরা বাধাপ্রাপ্ত সব স্থানে তাক্ষণিক সমাবেশ করি। সেনাবাহিনী ও পুলিশের শত প্ররোচনার মুখেও আমরা শান্ত ছিলাম। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিনা প্ররোচনায় পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের উপর হামলা চালায়। তারা নির্বিচারে মারধর ও লাঠিপেটা করে এবং গুলি চালায়। অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজিত হয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো – এতে কোন সন্দেহ নেই। শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় বাধা ও হামলার প্রতিবাদে আমরা পরদিন অর্থা ১৬ মার্চ দীঘিনালায় সড়ক অবরোধ আহ্বান করি, যা স্বতঃস্ফূতভাবে পালিত হয়।

সাংবাদিক ভাইয়েরা,
আমরা যে দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি, পদযাত্রা করলাম যে দাবী অত্যন্ত ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত। এটা দীঘিনালাবাসীর গণদাবী। ভারত প্রত্যাগত ২১ পরিবারকে যথাযথ পুনর্বাসনের পরিবর্তে উচ্ছেদ করে জোরপূর্বক তাদের জমি দখল করে সেখানে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর নির্মাণ করা চরম অমানবিক, অন্যায় এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এটা কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। এই ২১ পরিবার বার বার উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন। তারা কাপ্তাই বাঁধের  কারণে একবার ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন। এরপর ৮০ দশকে ভয়াবহ সেনা অপারেশনের সময় আবার উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। সর্বশেষ গত বছর বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে তাদের জমি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়া হলে তারা তৃতীয় বারের মতো নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হলেন।

আমরা মনে করি, বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তর শশী মোহন কার্বারী পাড়ার পরিবর্তে এমন একটি জায়গায় স্থাপন করা সম্ভব, যেখানে কাউকে উচ্ছেদ হতে হবে না। এবং সেটা করা হলে কেউ আপত্তি করবে না।

এক কথায়, বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর অন্যত্র স্থাপনের সুযোগ আছে, কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তারা এখন পথে বসেছে এবং জমি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

আমরা চাই ২১ পরিবারের প্রতি যে অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার করা হোক। কিন্তু সরকার সেটা না করে বরং এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে, এই ২১ পরিবারের অধিকারের পক্ষে কথা বলছে তাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাচ্ছে। স্থানীয় সেনাবাহিনী ও প্রশাসন এখন প্রকারান্তরে সমগ্র দীঘিনালাবাসীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ৮০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রশাসনের মারমুখী ও বৈরী আচরণ তারই প্রমাণ।

সাংবাদিক বন্ধুরা,
আমরা লক্ষ্য করছি যে, ১৫ মার্চ পদযাত্রায় হামলার পর গণ গ্রেফতার ও নির্যাতন করে সেনাবাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। তারা র‌্যাব সদস্যসহ দীঘিনালা ও সাজেকের বিভিন্ন গ্রামে তল্লাশীর নামে লোকজনকে হয়রানি করছে। জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি ছড়ানোর জন্য রাতে শত শত রাউন্ড ব্রাশ ফায়ার করছে। আমরা চাই, তারা এ ধরনের আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করুক।

বিজিবির বিজিবির বিশাল উপস্থিতি কেন?
আপনারা হয়তো অনেকে জানেন না, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিজিবি সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে ভরে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে মোট ১২ টি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও ৩ টি সেক্টর সদর দপ্তর রয়েছে। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরগুলো হলো খাগড়াছড়িতে ৪টি [রামগড়, পতাছড়া, পানছড়ি, বাবুছড়া], রাঙ্গামাটিতে ৫টি [মাজলং, মারিশ্যা, মাইনীমুখ, বরকল ও কাপ্তাই] এবং বান্দরবানে ৩টি [ বান্দরবান ২টি ও নাক্ষ্যংছড়ি]। সেক্টর সদর দপ্তর রয়েছে খাগড়াছড়িতে ২টি [খাগড়াছড়ি সদর ও গুইমারা] এবং রাঙ্গামাটিতে ১টি। সমতলের অন্যান্য জেলার সাথে তুলনা করলে এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক প্রতীয়মান হয়। সমতলের অন্য কোন জেলায় এভাবে বিজিবি মোতায়েন নেই, যদিও যেখানে সীমান্ত চোরাচালান ও নারী পাচার নিত্যদিনের ঘটনা। আমাদের প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশাল সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশ বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও এত বিশাল সংখ্যক বিজিবি মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা কেন? এই তিন জেলায় তো সীমান্ত চোরাচালানের ঘটনা খুবই কদাচি ঘটে। বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কাও তো নেই। তাছাড়া তা মোকাবিলার জন্য কয়েকটি সেনানিবাসই যথেষ্ট।

শেষে আমরা আবারো আমাদের দাবি পুনরাবৃত্তি করতে  চাই  :
১। বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া-শশী মোহন কার্বারী পাড়ার পরিবর্তে এমন স্থানে নির্মাণ করতে হবে যেখানে কাউকে উচ্ছেদের শিকার হতে হবে না।

২। যত্ন কুমার কার্বারী পাড়া ও শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়ন কর্তৃক  উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারকে নিজ নিজ জমিতে ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করতে হবে।

৩। ১১ জুন ২০১৪ ও ১৫ মার্চ ২০১৫ উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারের সদস্যসহ দীঘিনালাবাসীর বিরুদ্ধে দেয়া মিথ্যা মামলা তুলে নিতে হবে।

৪। ১৫ মার্চ ২০১৫ আটককৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।

৫। গ্রামে গ্রামে বাড়িঘরে তল্লাশীর নামে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।

কর্মসূচী :
উপরোক্ত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। হামলা, মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতনসহ কোন ধরনের ভয়ভীতি জনগণের এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে না। আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আগামীতে জনগণের বিভিন্ন মহলের সাথে মত বিনিময়সহ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচী অব্যাহত রাখবো। আমাদের দাবীর প্রতি দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি এবং মানবাধিকার সংগঠনের সমর্থন রয়েছে। তাদের সাথে একাত্মতা বাড়াতে কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। 

আমরা আশা করি, সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারের প্রতি সুবিচার করবে এবং আমাদের উপরোক্ত সমস্ত দাবি মেনে নেবে।

ধন্যবাদ।

চন্দ্র রঞ্জন চাকমা
চেয়ারম্যান, ৪ নং দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদ

সদস্য, দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটি।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More