নিজ দেশে ‘শরণার্থী শিবিরে’ সন্তোষ কার্বারী

0

॥ নিঝুম চাকমা ॥
গত ২০১৪ সালের ১০ জুন নিজ গ্রাম শশী মোহন কার্বারী পাড়া থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর ২১ পরিবার পাহাড়ির এখন ঠাঁই হয়েছে বাবুছড়ায় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরিত্যক্ত কার্যালয়ে। এখানে তারা গাদাগাদি করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তার আগে তারা বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণী কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদানে অসুবিধার কথা বিবেচনা করে তারা বর্তমান ‘শিবিরে’ চলে আসেন।

২১ পরিবারের বাস্তুভিটা এখন বিজিবি ৫১ ব্যাটালিয়নের দখলে। রাতের আঁধারে তারা জোর করে দুটো পুরো পাহাড়ি গ্রাম দখল করে নিয়েছিল। গ্রামবাসীদের তাড়িয়ে দেয়ার পর তারা এখন সেখানে হেডকোয়ার্টার নির্মাণ করছে। উঠছে ইট-লোহা-সিমেন্টের ইমারত। অন্যদিকে গ্রামের পাহাড়িরা গৃহহীন হয়ে নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। সরকার তাদের পুনর্বাসন দূরের কথা, খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয় না।

এই উচ্ছেদ হওয়া গ্রামবাসীদের মধ্যে একজন হলেন সন্তোষ কার্বারী। তিনি শশীমোহন কার্বারী পাড়ার বর্তমান কার্বারী, অর্থাৎ গ্রাম প্রধান। ৭৬ বছর বয়স তার। ইতিপূর্বেও তিনি ব্যাপক সেনা অপারেশনের কারণে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। ভারতে ১২ বছর শরণার্থী জীবন কাঠানোর পর দেশে ফিরে আসেন। নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য তার নিজ গ্রামে বাড়ি নির্মাণ করে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাকে আবার উচ্ছেদের শিকার হতে হলো। ফলে নতুন আশ্রয় শিবিরে শুরু তার আবার জীবন সংগ্রাম। এখানে লোকজনের সামান্য ত্রাণ সাহায্যের উপর বাঁচা দায়। স্থানীয় প্রশাসনের টিকিরও দেখা নেই, সাহায্য দেয়া দূরের কথা। তাই তাকে এখানে লেই (বেতের ঝুড়ি) বুনে সংসার চালাতে হয়।

# আশ্রয় শিবিরে লেই(বেতের ঝুড়ি)  বুনছেন সন্তোষ কার্বারী।
# আশ্রয় শিবিরে লেই(বেতের ঝুড়ি) বুনছেন সন্তোষ কার্বারী।

সন্তোষ কুমার কার্বারীর সাথে গত ১১ মে যখন বাবুছড়া উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরিত্যক্ত কার্যালয়ে দেখা হয় তখন তিনি লেই বুনছেন। আর তার স্ত্রী রত্নামালা চাকমা রাতের খাবার রান্নার উদ্যোগ নিচ্ছেন। সন্তোষ কার্বারী জানালেন বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদের শিকার হবার পর তিনি ও তার স্ত্রী এবং তার দুই নাতি অতিকষ্টে সেখানে বসবাস করছেন। তিনি চাকমা কথায় বললেন, ‘লেই বুনঙ্গে বুঝো। সংসার ন চলে, লেই বুনিনেই সংসার চালানা আই (বাঁশের ঝুড়ি বুনছি বুঝছেন। সংসারে টানাপোড়েন থাকে, তাই লেই বুনে সংসার চালাতে হয়)।

সপ্তাহে দুই এক জোড়া লেই বুনে শেষ করার পর তিনি বাজারে সেগুলো বিক্রি করে ৪০০/৫০০ টাকা পান বলে জানান। তিনি জানালেন, ১৯৮৯ সালের দিকে তারা প্রাণের ভয়ে ও সেনাবাহিনী-সেটলার বাঙালির অত্যাচারে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হন। তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবার সাথে সাথে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামের ভিটেমাটিতে  অস্থায়ী চৌকি বানায়। তিনি জানালেন, সে সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রামের বিরাট বিরাট আম কাঁঠাল জাম বটগাছ ধ্বংস করে দিয়ে তাদের গ্রামের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

১৯৯৮ সালের দিকে তারা ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে আসেন। ফিরে এসে নিজের চোখে দেখেন তাদের গ্রামের দশা। বেশ কয়েক বার নিজেদের গ্রামে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করার পরে ২০১২ সালে তিনি তাদের পুরাতন গ্রামের পাহাড়ি ভিটায় একটি ঘর বানান। পরে তিনি তা দোকানঘরে রূপান্তরিত করেন। বিজিবি কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা স্বামী স্ত্রী দুইজন ও তাদের দুই নাতিসহ সেই ঘরে থাকতেন।

তিনি জানেন না তাদেরকে আর কতকাল এভাবে নিজ দেশে শরণার্থীর মতো জীবন কাটাতে হবে। তার প্রশ্ন ‘এ দেশে কি একটু শান্তিতে থাকার অধিকার আমাদের নেই? আমরা কি এদেশের নাগরিক নই? পাহাড়ি হয়ে জন্ম হয়েছে বলেই কি আমাদের অপরাধ?’ তিনি দাবি জানান হয় তাদের জমি জমা ফিরিয়ে দেয়া হোক, নতুবা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন করা হোক।
—————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More