নির্বিচার পর্যটন পরিবেশের জন্য হুমকী হতে পারে

0

।। উইন মারমা ।।
থাইল্যান্ডকে বলা যায় বিশ্বের ভ্রমণকারীদের তীর্থভূমি। থাই সরকার প্রতি বছর ট্যুরিজম সেকটর থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করে থাকে। কিন্তু এই থাইল্যান্ডই সম্প্রতি প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে কোহ্ তাচাই দ্বীপে পর্যটন কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বিবিসি ওয়েবসাইটে এ খবর দেয়া হয়েছে। (বিস্তারিত দেখুন: http://www.bbc.com/news/world-asia-36309103)

Nilgiri-Bandarbanউক্ত খবরে বলা হয়েছে, ‘Thai authorities are set to close the island of Koh Tachai, saying heavy tourism is negatively affecting natural resources and the environment.’ থাই সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশন্যাল পার্কস, ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড প্লান্ট কনজারভেশন এর ডিরেক্টর জেনারেল তুন্যা নেটিথাম্মাকুল ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, ” We have to close it to allow the rehabilitation of the environment both on the island and in the sea without being disturbed by tourism activities before the damage is beyond repair,” অর্থাৎ আমরা এটা বন্ধ করছি, যাতে ক্ষতির মাত্রা অপূরণযোগ্য হওয়ার আগে ভূমি ও সমুদ্র উভয় জায়গায় পরিবেশকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। পর্যটন কার্যক্রম দ্বারা বিঘ্নিত হলে তা সম্ভব হবে না।

থাই সরকারের এই সিদ্ধান্ত থেকে আমাদেরও শিক্ষা নেয়া দরকার। মূলত সেনাবাহিনীর পরামর্শে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে যত্রতত্র পর্যটন স্পট বানাচ্ছে এবং সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও স্থানীয় জুম্ম সংস্কৃতির উপর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, এক সময় সাজেক অঞ্চলটি গহীন অরণ্যে পরিপূর্ণ ছিল। ঘন বনের আচ্ছাদনের কারণে সূর্য দেখা যেতো না। বনে বাঘ, ভালুক, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ বিচরণ ছিল। পার্বত্য চুক্তির পর কয়েক বছর পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজমান ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী ২০০৫ – ২০০৬ সালের দিকে বাঘাইহাট থেকে রুইলুই পাহাড় পর্যন্ত একটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। এই রাস্তার ফলে সেখানে লোকজনের যাতায়াত সহজ হয়েছে সত্য, কিন্তু প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের উপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। কয়েক বছরের মধ্যে সাজেক বৃক্ষশুন্য বিরানভূমিতে পরিণত হয়। ব্যবসায়ীরা পাকা রাস্তার পূর্ণ সুযোগ নেয় এবং এর ফলশ্রুতিতে গর্জন, চাম্পাফুল, চাপালী ইত্যাদি শতবর্ষী বড় বড় গাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাজেকের এই অবস্থা স্বপন আদনানের গবেষণার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। তিনি তার গবেষণামূলক গ্রন্থ Migration, Land Alienation and Ethnic Conflict: Causes of Poverty in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh -এ বলেন, “Our fieldwork observations indicate that, wherever Pahari settlements have been opened up by expansion of road and water transport networks, they have also been exposed to the entry and interventions of outsiders, inclusive of traders, settlers, officials, security forces and development agencies. Travelling across the CHT, we have been struck by the fact that the existence of good roads was almost always associated with significant extents of deforestation, soil erosion, environmental degradation, in-migration by settlers and traders, forcible takeover of pahari lands, the establishment of rubber plantations etc. (অর্থাৎ আমাদের মাঠের কাজের পর্যবেক্ষণ এই ইঙ্গিত দেয় যে, যেখানে পাহাড়ি বসতিগুলো সড়ক ও পানি পথের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক দ্বারা খুলে দেয়া হয়েছে সেখানে বহিরাগতরা অর্থাৎ ব্যবসায়ী, সেটলার, সরকারী কর্মকর্তা, নিরাপত্তাবাহিনী ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো ঢুকে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরে আমরা এটা দেখে অবাক হয়েছি যে, প্রায় সকল সময় ভালো রাস্তার উপস্থিতির সাথে সম্পর্কিত হচ্ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বন ধ্বংস-সাধন, ভূমির অবক্ষয়, পরিবেশগত অবনমন, সেটলার ও ব্যবসায়ীদের আগমণ, জোরপূর্বক পাহাড়িদের জমি হরণ, রাবার বাগান সৃষ্টি ইত্যাদি।) [বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রজত জয়ন্তী স্মরণিকা ‘প্রতিরোধ’ এ উদ্ধৃত]

সরকার পাহাড়ি সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য অনেক কথা বলে থাকে। কিন্তু বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল দেখা যায় না। সরকারের তথাকথিত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পাহাড়ি সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বনের সাথে পাহাড়িদের জীবন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিবিড়ভাবে জড়িত। বন হলো তাদের লাইফ-লাইন। বন থেকে তারা তাদের জীবন ধারণের সকল উপকরণ পেয়ে থাকে। তাই বন থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করা মানেই তাদেরকে উৎপাদন ও জীবিকার উপায় থেকে তথা তাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। পানি থেকে ডাঙায় তুললে মাছের যে অবস্থা হয়, বন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পাহাড়িদেরও একই অবস্থা হয়। কেন এক কালে বিশেষত পাকিস্তান আমলে পাহাড়িদেরকে আধুনিক শিল্প কারখানায় শ্রমিক হিসেবে পাওয়া যায়নি অথচ বর্তমানে তারা দলে দলে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সমতলের বিভিন্ন জেলায় কলকারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগদান করছে, তার যথাযথ ব্যাখ্যা তাদের জীবিকার উপায় অর্থাৎ বন ও ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যেই পাওয়া যায়। অতীতে উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে এক এলাকা থেকে উচ্ছেদ হলেও জীবিকার জন্য তাদের পাহাড়ি বনের অভাব ছিল না, তারা অন্যত্র গিয়ে জুম চাষ করতে পারতো। কিন্তু এখন সে সুযোগ ও অবস্থা আর নেই।

অন্যদিকে দেখা যায়, বিগত শতকের ৭০ ও ৮০ দশকে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে যে বাঙালিদেরকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে তারা বনের উপর নির্ভর করে বাঁচতে পারে না। স্থায়ীভাবে বন ধ্বংস না করে তারা জীবন ধারণের উপায় করতে পারে না। বনে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি এবং বিভিন্ন বন্য-প্রাণীজ প্রোটিন তাদের কাছে খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। সে কারণে পাহাড়িরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে তোলার আগে পাহাড় বাঙালিদের কোনভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়নি। পাহাড়িদের বসতির পর তারা এখানে এসেছে প্রথমে হালচাষের শ্রমিক হিসেবে এবং পরে ব্যবসা ও চাকুরীর প্রয়োজনে। ১৯৭০ – ৮০ দশকে সেটলারদের নিয়ে আসা হয় পাহাড়িদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য। তবে তারা কেবল পাহাড়িদের আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, বন ও পরিবেশ ধ্বংসেরও কারণ হয়েছে। এক হিসেবে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অনুপাতে বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটেছে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সমতলের বাঙালি বেনিয়া শ্রেণীর ব্যবসায়িক যোগাযোগ বেড়েছে, সেই অনুপাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজ সম্পদ উজার হয়েছে। এই সরল সত্যটি উপলব্ধির জন্য পরিসংখ্যানবিদ কিংবা গবেষক হওয়ার দরকার পড়ে না। বর্তমানে পর্যটনের নামে যে infrastructure গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে পাহাড়িদের বন ও সংস্কৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত হবে।

কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন বিষয়ে সরকারের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সময়ে এক ফোঁড়, অসময়ে দশ ফোঁড়েও আর হবে না। সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আগে সময় থাকতে পর্যটন সম্পর্কিত বেপরোয়া কার্যক্রম বন্ধ করে দিন, যেমনটা থাইল্যান্ডের সরকার তাদের দেশে করেছে। #
—————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More