পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে ইউপিডিএফ যে দাবি জানিয়েছিলো

0

সিএইচটিনিউজ.কম
আগামী ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের ৪ বছর পূর্ণ হবে। ২০১১ সালের ৩০ জুন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিসমূহের উপর বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়ে বিতর্কিত এ বিলটি সংসদে পাস করে। বিলটি পাসের আগে ৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ সংবিধান সংশোধন কমিটির কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ৬টি সংশোধনীর দাবি পেশ করে। কিন্তু এসব দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সরকার ৩০ জুন ২০১১ ক্ষমতার জোরে বিতর্কিত এ বিলটি সংসদে পাস করে। এতে ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের ২-এ বলা হয়েছে “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন”।

UPDF flag1বিতর্কিত  এ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্ববৃহৎ মানববন্ধন, তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ সহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে এবং ৩০ জুনকে অভিশপ্ত দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

আগামী ৩০ জুনকে সামনে রেখে আমরা ইউপিডিএফ’র পেশকৃত দাবিনামা আবারো এখানে প্রকাশ করছি:

১।”নবম-খ ভাগ” নামে একটি বিভাগ সংযোজন করা, যার শিরোনাম হবে “সংখ্যালঘু জাতির অধিকার সম্পর্কিত বিধানাবলী” এবং এই ভাগের অধীনে ১৪১ঘ অনুচ্ছেদ যোগ করে নিম্নোক্ত বিধান সন্নিবেশিত করা:

“নবম খ ভাগ
সংখ্যালঘু জাতির অধিকার সম্পর্কিত বিধানাবলী

১৪১ ঘ। (১) দেশে বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, মুরুং, গারো, মুনিপুরী ও সাঁওতালসহ ৫ম তফসিলে [এরপর ৫ম তফসিল নামে একটি তফসিল সংযোজিত করা, যেখানে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতির নাম সন্নিবেশিত হবে] বর্ণিত বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতির জনগণের সার্বিক উন্নতিকল্পে তথা তাহাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, কৃষ্টি ও ধর্মীয় বিশ্বাস সংরক্ষণ ও বিকাশের স্বার্থে দেশের কোন বিশেষ এলাকাকে “স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল” বলিয়া ঘোষণা করা যাইবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হইবে এ ধরনের একটি “স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল”।

(২) সরকার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে আইনের দ্বারা পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গঠন করিতে পারিবে, যা ঐ অঞ্চলে বসবাসরত স্থায়ী বাসিন্দাদের দ্বারা নির্বাচিত হইবে এবং, এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগে যাহাই বলা হউক না কেন, এইরূপ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে নাগরিকদের চলাফেরা, যাতায়াত ও বসতিস্থাপন নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবে।

(৩) দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতির জনগণের নিজস্ব প্রথাগত ভূমি ও অন্যান্য অধিকার যেমন খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ সংরক্ষিত থাকিবে; স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বসবাসরত স্থায়ী বাসিন্দা ব্যতিত অন্য কাহারো নিকট জমি বিক্রয়, বন্দোবস্তি, ইজারা বা অন্য কোন উপায়ে হস্তান্তর কিংবা তাহাদের প্রকাশ্য সম্মতি ব্যতিত সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা যাইবে না।

(৪) এই ভাগে বর্ণিত অধিকার ক্ষুন্ন হয় এমন কোন আইন কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বার্থ সম্পর্কিত কোন আইন সংসদে উত্থাপনের পূর্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের মতামত, প্রয়োজনবোধে গণভোটের মাধ্যমে, গ্রহণ করিতে হইবে।

(৫) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা বলা হউক না কেন, এই ভাগের কোন বিধান সংশোধনের (সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ) ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের সম্মতির প্রয়োজন হইবে।”

ব্যাখ্যা: বাংলাদেশ বহুজাতিক ও বহুভাষিক দেশ। এখানে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ট জাতি হলেও আনুমানিক ৪৫টি সংখ্যালঘু জাতির জনগণও স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছেন। দেশে বসবাসরত সকল জাতির মধ্যে সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধানে তাদের স্বীকৃতি একান্ত প্রয়োজন।

সংখ্যালঘু জাতির জনগণ যুগ যুগ ধরে অবহেলি, শোষিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। স্বাধীনতার পর রচিত সংবিধানে তাদের স্বাতন্ত্র্য সত্তাকে স্বীকার করা হয়নি। ফলে কোন সরকার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। জাতিসংঘ সনদে ছোট-বড় প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সম্প্রতি আদিবাসী সংখ্যালঘু জাতির অধিকার বিষয়ক ঘোষণা অনুমোদিত হয়েছে। বিশ্বের বহু সরকার তাদের দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতিসমূহের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছে ও তাদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের দেশে তাদেরই পূর্বপুরুষদের দ্বারা অতীতে আদিবাসী জাতিগুলোর ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য ক্ষমা চেয়েছে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, ইতালী, স্পেন, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।

বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অস্তিত্ব ও অধিকার মেনে নিয়ে সংবিধানে বিশেষ বিধান সংযোজন করা এখন সময়ের দাবি। দেশে সকল জাতির ও সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বন্ধন গড়ে তোলার জন্য এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে পশ্চাদপদ রেখে একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা জারী রেখে দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হতে পারে না।

২। প্রথমভাগে বর্তমান ৬(২) অনুচ্ছেদ বলবৎ রাখা।
ব্যাখ্যা: বাংলাদেশে বসবাসরত নাগরিকদের জাতিগত পরিচয় ভিন্ন হতে পারে যেমন বাঙালি, চাকমা, মারমা  ইত্যাদি, কিন্তু তারা সবাই বাংলাদেশী নাগরিক।

৩। দ্বিতীয় ভাগের ১৩ অনুচ্ছেদের (গ) দফার পর “ঘ” দফা সংযোজিত করা, যাতে থাকবে: “যৌথ মালিকানা, অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতির প্রথাগত মালিকানা।”
ব্যাখ্যা: বর্তমান সংবিধানে কেবল তিন ধরনের মালিকানা স্বীকৃত। সংখ্যালঘু জাতিসমূহের যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাগত যৌথ মালিকানারও স্বীকৃতি প্রয়োজন। এই ধরনের মালিকানার স্বীকৃতি না থাকার কারণে সংখ্যালঘু জাতির জনগণের জমিজমা বহিরাগতদের দ্বারা প্রতিনিয়ত বেদখল হয়ে যাচ্ছে।

৪। তৃতীয় ভাগের ২৮নং অনুচ্ছেদের দফা (৪) এ “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য” শব্দসমূহের পর নিম্নোক্ত শব্দসমূহ সংযোজন করা: “কিংবা সংখ্যালঘু জাতির জনগণের সার্বিক উন্নয়নকল্পে”।
ব্যাখ্যা: সংখ্যালঘু জাতির জনগণের স্বার্থে বিধি বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধা দূর করার জন্য এর সংযোজন প্রয়োজন।

৫। পঞ্চম ভাগে ৬৫ নং অনুচ্ছেদের (২) দফার পর নিম্নরূপ “২ক” দফা সংযোজন: “সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের ১টি আসনসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদীয় আসনমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জনগণের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে।”
ব্যাখ্যা: জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাদপদ পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের বিধান অপরিহার্য।

৬। নবম-ক ভাগের ১৪১খ ও ১৪১গ অনুচ্ছেদ বাদ দেয়া। [জরুরী অবস্থা জারীর ক্ষমতা]
ব্যাখ্যা: জরুরী অবস্থা জারীর বিধান গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই বিধান থাকা উচিত নয়।
—————————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More