পাঁচ বছরে পাহাড়িদের উপর ১০ সাম্প্রদায়িক হামলা

0

বিশেষ প্রতিবেদন, সিএইচটিনিউজ.কম

বগাছড়ি সেটলার হামলা
বগাছড়িতে সেটলার হামলায় এভাবে  পুড়ে ছাই হয়ে যায় ঘরবাড়ি

বাংলাদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত একটি অঞ্চলের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানে আজো সেনাশাসন বলবৎ রাখা হয়েছে।  স্বাধীনতার পর থেকেই এই অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের উপর  সেনা-সেটলার কর্তৃক একের পর এক গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়ে আসছে। কাউখালী, লোগাং, মাল্যা, নান্যাচর গণহত্যা সহ এ পর্যন্ত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এই পার্বত্য চট্টগ্রামে। এছাড়া প্রতিনিয়ত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এই উগ্রসাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে কোনভাবেই মুক্তি মিলছে না পাহাড়িদের। সম্প্রতি গত ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ আবারো রাঙামাটির নান্যাচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়ি এলাকায় একটি বৌদ্ধ বিহারসহ তিনটি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বসতবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৪ এই ৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের উপর কমপক্ষে ১০টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ২টি, ২০১১ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৩টি, ২০১২ সালে রাঙামাটিতে ১টি, ২০১৩ সালে খাগড়াছড়িতে ২টি ও ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ২টি (সর্বশেষ বগাছড়ি হামলাসহ) হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো:

২০১০ :
:: ১৯-২০ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে পাহাড়িদের উপর সেনা-সেটলাররা সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। সেনারা

সাজেকে সেটলারদের অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত বুদ্ধমূর্তি। # ফাইল ছবি
সাজেকে সেটলারদের অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত বুদ্ধমূর্তি। # ফাইল ছবি

সেটলারদের পক্ষ নিয়ে বেপরোয়াভাবে পাহাড়িদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে সেনাবাহিনীর গুলিতে লক্ষী বিজয় চাকমা ও বুদ্ধপুদি চাকমা নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়। সেটলারা পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বৌদ্ধ মন্দির সহ কমপক্ষে ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়।

:: ২৩ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা শহরে সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। তারা মহাজন পাড়া, সাতভাইয়া পাড়া, কলেজ পাড়া সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করে। এতে কমপক্ষে ৬৩টি বাড়ি ও দোকান পুড়ে ছাই করে দেয়া হয়।

২০১১ :
::
 ১৭ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটির লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নের রঞ্জিত পাড়া ও বগাচদর ইউনিয়নের রাঙ্গী পাড়া এলাকায় সেটলাররা পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এতে কমপক্ষে ২৩টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।

রামগড়ের শনখোলা পাড়ায় সেটলারদের লাগিয়ে দেয়া আগুন পুড়ছে বাড়ি। # ফাইল ছবি
রামগড়ের শনখোলা পাড়ায় সেটলারদের লাগিয়ে দেয়া আগুন পুড়ছে বাড়ি। # ফাইল ছবি

:: ১৭ এপ্রিল সেটলাররা খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, মানিকছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। সেটলাররা উত্তর শনখোলা পাড়া, সুলুডঙ পাড়া, রেম্রঙ পাড়া, তৈকর্মা পাড়া, পদাছড়া ও মানিকছড়ির মহামুনি পাড়ায অগ্নিসংযোগ করে একটি বৌদ্ধ বিহারসহ কমপক্ষে ৯৫টি বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেয়। এছাড়া সেটলাররা জালিয়া পাড়ায় যাত্রীবাহী বাসে হামলা চালিয়ে বহু পাহাড়িকে আহত করে। এ ঘটনায় মিপ্রু মারমা নামের এক কিশোরী গুরুতর আহত হয় এবং আশীষ চাকমা নামে এক ছাত্র নিঁখোজ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত আশীষ চাকমার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।

:: ১৪ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ি সদর ও দিঘীনালা উপজেলার কবাখালীতে সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। সেটলারদের এ হামলায় কবাখালী এলাকার চিগোন মিলা চাকমা নিহত হয় এবং কমপক্ষে ১১জন পাহাড়ি আহত হয়। এক বাঙালি মোটর সাইকেল চালকের লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে সেটলাররা এ হামলা চালায়।

২০১২ :
::
২২-২৩ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে  সেটলারদের

রাঙামাটি শহরে সেটলার বাঙালিদের হামলায় গুরুতর আহত ডা: সুশোভন দেওয়ান। # ফাইল ছবি
রাঙামাটি শহরে সেটলার বাঙালিদের হামলায় গুরুতর আহত ডা: সুশোভন দেওয়ান। # ফাইল ছবি

এ হামলায় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, চিকিৎসক সহ কমপক্ষে শতাধিক পাহাড়ি আহত হয়। সেটলাররা পাহাড়িদের বেশ কয়েকটি দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পাহাড়ি চিকিৎসকদের চেম্বারে হামলা চালায় ও ব্যাপক ভাঙচুর করে।  সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতেই সেটলাররা এ হামলা চালায়।

২০১৩ :
::
 ২৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার হরিধন মগ পাড়া ও হেমঙ্গ পাড়ায় সেটলাররা হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে কমপক্ষে ২টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ৩৫টি বাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়।

:: ৩ আগস্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ে সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি গ্রামে

তাইন্দংয়ে সেটলাদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া ধান ও ঘরবাড়ি # ফাইল ছবি
তাইন্দংয়ে সেটলাদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া ধান ও ঘরবাড়ি # ফাইল ছবি

হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে পাহাড়িদের ৩৫টি বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া সেটলাররা দু’টি বৌদ্ধ বিহার আক্রমণ করে। একটি বৌদ্ধ বিহারের দেশনা ঘর পুড়ে দেয়া সহ দু’টি বৌদ্ধ বিহারেই বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সেটলাররা পাহাড়িদের ৪ শতাধিক বাড়িঘরে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। সেটলারদের এ হামলায় ১৩টি গ্রামের ৯ শতাধিক পাহাড়ি পরিবারের তিন সহস্রাধিক নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ পালিয়ে ভারতের সীমান্তে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এবং পানছড়ি উপজেলাসহ আশে-পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এতে প্রত্যেক পরিবারই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০১৪
:: ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি ও বেতছড়িতে বাঙালি সেটলাররা পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়। এ সময় তারা

খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সেটলার হামলায় গুরুতর আহত পান্দুক্যা চাকমা। # ফাইল ছবি
খাগড়াছড়ির কমলছড়িতে সেটলার হামলায় গুরুতর আহত পান্দুক্যা চাকমা। # ফাইল ছবি

পাহাড়িদের বাড়িঘরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, জিনিসপত্র ভাংচুর, লুটপাট ও একটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালায়। এ হামলায় কমপক্ষে ৫ জন পাহাড়ি গুরুতর আহত হয়।

সর্বশেষ, গত ১৬ ডিসেম্বর বুড়িঘাট ইউনিয়নে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা সুরিদাস পাড়া, বগাছড়ি ও নবীন তালুকদার পাড়ায় পাহাড়িদের কমপক্ষে ৫০টি বসতবাড়ি, ১টি ক্লাব ও ৭টি দোকান(বিভিন্ন তথ্য মতে ৫৪টি বাড়ি ও ৭টি দোকান) জ্বালিয়ে দেয়, করুণ বনবিহার নামের একটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে ধর্মীয় গুরুকে মারধর, বিহারের জিনিসপত্র-বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর, বুদ্ধমূর্তি ও টাকা পয়সা লুট এবং বিহারে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা চালায়। এ হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা বর্তমানে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি ছোটখাটো হামলার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব হামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভূমি বেদখল। মূলত পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতেই রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা মাফিক এধরনের হামলা চালানো হয়। সেনাবাহিনীর কায়েমী স্বার্থবাদী অংশটি এসব হামলার মদদ দিয়ে থাকে। ফলে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনপ্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

এ যাবত যত হত্যাকান্ড ও হামলা সংঘটিত হয়েছে তার কোন ঘটনারই সঠিক তদন্ত ও বিচার হয়নি। ফলে হামলাকারী ও হামলার মদদদানকারীরা রেহাই পেয়ে যাওয়ার কারণে বার বার এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।

এসব হামলা বন্ধে সরকারের যেহেতু কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই, তাই জনগণকেই হামলা প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
—————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

 

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More