পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এদিন…
* কলমপতি হত্যাকাণ্ড ১৯৮০
১৯৮০ সালের এদিন কাউখালির কলমপতি ইউনিয়নে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। জনসভার কথা বলে এদিন সেনা কর্মকর্তারা স্থানীয় বাজারে লোকজন জড়ো করে। সভায় আগত লোকদের ওপর নৃশংসভাবে ব্রাশ ফায়ার করে এবং সেটলারদের লেলিয়ে দেয়। সেনা ও সেটলারের হামলায় এ হত্যাকাণ্ডে ৩০০-এর অধিক নিরীহ পাহাড়ি প্রাণ হারায়। নিকটস্থ বৌদ্ধ বিহারে হামলা করে ভিক্ষুকেও গুরুতর জখম করে এবং পুরো এলাকা তাণ্ডব লুটপাট চালায়। এ হত্যাকাণ্ড ১৯৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনীয়।
* ৭ দফা রাজনৈতিক প্রস্তাব পাস ১৯৯৭
১৯৯৭ সালে ২৫ মার্চ সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতির সংলাপের প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে তৎকালীন তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন পাহাড়ি গণপরিষদ-পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকায় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের ২৭জন নেতা-কর্মী অংশগ্রহণ করেন। ২৫-২৭ মার্চ তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ঐতিহাসিক ৭ দফা প্রস্তাবনা গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের শর্ত ও ভিত্তি তৈরি করে।
দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনা শেষে বৈঠকে প্রতিনিধিগণ এই মর্মে ঐকমত্যে উপনীত হন যে, জনসংহতি সমিতি পূর্বের প্রগতিশীল সংগ্রামী চরিত্র হারিয়েছে, সমিতির নেতৃত্বে আপোষকামী-সংশোধনবাদী ধারাটির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে পরিণত হয়েছে এবং কোন প্রাইভেট কোম্পানী দিয়ে জাতীয় অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা সম্ভব নয়।
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতীয় আন্দোলনে জনসংহতি সমিতির প্রথম দিকের সংগ্রামী ভূমিকার কথাও সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করা হয়।
সরকার ও জনসংহতি সমিতির চলমান সংলাপ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে প্রতিনিধিগণ মন্তব্য করেন যে, আপোষ চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মুক্তি অর্জিত হবে না। সভায় জেএসএস-এর আপোষকামী ধারাটির বিভিন্ন সন্দেহজনক কার্যকলাপ ও বিচ্যুতিরও কঠোর সমালোচনা করা হয়। প্রতিনিধিগণ যে কোন পরিস্থিতিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিতর্কিত ‘পার্বত্য চুক্তি’ সম্পাদনের নয় মাস পূর্বে তিন গণতান্ত্রিক সংগঠন কর্তৃক গৃহীত ৭দফা রাজনৈতিক প্রস্তাবনা নিচে হু বহু তুলে ধরা হলো। অনুসন্ধিৎসু ও অগ্রসর পাঠকদের চাহিদা মেটাতে পুরো দলিলটি প্রথম বারের মত প্রকাশিত হলো, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
গৃহীত ৭দফা নিম্নরূপ :
১। জে.এস.এস’এর মূল নেতৃত্ব সংশোধনবাদীতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ জে.এস.এস-এর আপোষমুখী ধারাটি প্রাধান্যে রয়েছে। পুরো সংগঠনটি একটি মহল বিশেষের “প্রাইভেট কোম্পানীতে” পরিণত হয়েছে এবং সেজন্যে এ দলটির দ্বারা আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করা আর সম্ভব নয়।
২। জে.এস.এস’এর আপোষকামী ধারাটি সরকারের সাথে আপোষের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সম্ভাব্য আপোষ চুক্তির মধ্যে জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জিত হওয়া ন্যূনতম সম্ভাবনা বর্তমান পরিস্থিতিতে নেই।
৩। প্রতিনিধিবৃন্দ যে কোন পরিস্থিতিতে জুম্ম জনগণের মুক্তি আন্দোলন এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
৪। পুরো জে.এস.এস’এর সাথে বাইরের “তিন সংগঠনের নেতৃত্বের” দ্বন্দ্ব নয়। প্রতিনিধিবৃন্দ আন্দোলনের সঠিক লাইন প্রতিষ্ঠার জন্য মতাদর্শগত লাইন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালাবে এবং অপরদিকে জনসংহতি সমিতির সাথে বিভিন্ন ইস্যু ও দাবীদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কৌশলগত ঐক্যের জন্য সংগ্রাম করবে।
৫। জে.এস.এস’এর এক সময়কার অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি লড়াই’এর প্রথম দিকে প্রগতিশীল অর্থাৎ বিপ্লবী ভূমিকার কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্বীকার করছে। কিন্তু বর্তমানে সংগঠনটি তার সেই চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে।
৬। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঐক্য ও সংহতি হবে অবিভাজ্য।
সকল জাতিসত্তার বিকাশের মধ্যে আমাদের উন্নয়ন সমৃদ্ধি ও অস্তিত্ব নিশ্চত সম্ভব।
৭। পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের মধ্যে অধিকতর সংহতি জোরদারের লক্ষ্যে অভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্যে সমন্বয়ের জন্য তিন সংগঠনের মধ্যে সমমনা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দ্বারা।
———————
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।