পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিজম যখন ট্র্যাজেডি

0
ছবিটি বান্দরবানের “নীলগিরি” নামক একটি পর্যটন কেন্দ্রের। সেনাবাহিনী কর্তৃক গড়ে তোলা এ পর্যটনের কারণে ম্রো জাতিসত্তার লোকজনকে উচ্ছেদের শিকার হতে হয়। সংগৃহিত ছবি।

ট্যুরিস্ট তত্ত্বঃ
‘Tourist’ শব্দটি উৎপত্তি ঘটে ল্যাটিন শব্দ ‘tornus’ থেকে, যার অর্থ ‘A tool for describing a circle’. সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে „Tourist‟ শব্দটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করার ক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহৃত হয়। John Urry বলেছেন Postmodernist tourist তারা ভ্রমণকে এক ধরণের খেলা হিসেবে গ্রহণ করে। তাই তারা ভ্রমণ করে কোন একটা অভিজ্ঞটা অর্জনের পরিবর্তে যত ধরণের অভিজ্ঞটা পাওয়া যায় তাঁর সবগুলো উপভোগ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ Postmodernist tourist রা কোন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণ করে না, ভ্রমনের পিছনে থাকে বহু উদ্দেশ্য।

Featherstone (1991) বলেছেন “In the late periods of the twentieth century, the search of leisure has become an indispensible component of contemporary of leisure has become an indispensible component of contemporary consumer culture”.

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ‘Tourist’ এবং “Traveler”-এর মধ্যে পার্থক্য আছে।

ডার্ক ট্যুরিজমঃ
১৯৯৬ সালে ডার্ক ট্যুরিজম (Dark Tourism) এর সংজ্ঞা প্রবর্তন করেন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই ফ্যাকাল্টি সদস্য জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলি। তাদের সংজ্ঞানুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট ট্র‍্যাজেডির সাথে সম্পর্কিত স্থানে ভ্রমণ করাকে ডার্ক ট্যুরিজম বলে। কোনো স্থান অতীতের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকলে সেই স্থানে দর্শন করা ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত। এই ভয়াবহতা হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা মানবসৃষ্ট কোনো ঘটনা। রা মনে করেন, ডার্ক ট্যুরিজম অনেকটা মানব সভ্যতা বিষাদের ইতিহাসের স্বাক্ষী এসব স্থানকে উপর আকর্ষণের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত। তার মানে, সাজেক, নীলগিরি, নীলাচল থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি টুরিস্ট স্পটই হচ্ছে ডার্ক ট্যুরিজমে অন্তর্ভুক্ত। ডার্ক ট্যুরিজম সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায়। এক অঞ্চলের জনগোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে অন্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার। অমানবিকতার ইতিহাসের স্বাক্ষী পাওয়া যায়, সেখানেই ডার্ক ট্যুরিজমের প্রবল। নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষী পোল্যান্ডের অসউইৎজ ক্যাম্প, পারমাণবিক বোমায় হারিয়ে যাওয়া হিরোশিমা, নাগাসাকির ধ্বংসাবশেষ এবং কাপ্তাই বাঁধের কারণে চাকমা জাতির সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ যা পাহাড়ি মানুষের বেদনার স্বাক্ষী। মানুষের বেদনা-কষ্টকে পুঁজি করে পর্যটন গড়ে তোলাই ডার্ক ট্যুরিজম। ডার্ক ট্যুরিজম স্থানগুলো চিহ্নিত করার জন্য বহু সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ডার্ক ট্যুরিজমে প্রসঙ্গ বাদ দিলাম প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের লাশের উপরে দিয়েই ডার্ক ট্যুরিজম নির্মাণ করা হচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিজম-উন্নয়নের অগ্রাসনঃ
উন্নয়নের সাথে সাথে পর্যটনের চরিত্রও বদলে দিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। এখন পর্যটনকে শিল্পে পরিণত করছে। রাষ্ট্রকে ডিজিটাল বানাচ্ছে কিন্তু যেখানে পর্যটন স্পট নির্মাণ করছে সেখানেকার এলাকা প্রযুক্তির বাইরে। আর অন্যদিকে পর্যটনের সৌন্দর্য নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। উন্নয়নের সাথে সাথে ঘুষখোর, দালালি, দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী বাহিনী তৈরি করছে, তাদের হাতে জনগণের টাকা তুলে দিচ্ছে। এবার অবসরের দরকার। এই অবসর সময়টা তারা কিভাবে কাটাবে সেটাও ঠিক করে দিচ্ছে শাসকগোষ্ঠী। শাসকগোষ্ঠী দেখবে অবসর কাটাতে গিয়ে ওই বাহিনী (ঘুষখোর, দালালি, দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী) যাতে উন্নয়নের ক্যাপিবিলিটি হারিয়ে না বসে। ফলে শাসকগোষ্ঠী ঠিক করে দিচ্ছে ওই বাহিনী কোথায় কিভাবে বেড়াবে। এজন্য পাহাড়ে-সমতলে আদিবাসীদের ভূমি দখল করে নতুন নতুন পর্যটন স্পট তৈরি করে দিচ্ছে। ঘুষখোর, দালালি, দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী যেমন বাড়াচ্ছে বেড়ানোর স্পট ও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার ওই বাহিনী বেড়াতে গিয়ে যে খরচ করছে তা ঢুকছে সেনাবাহিনী- প্রশাসন কিংবা শাসক গোষ্ঠীর ঘরেই। পর্যটন আগে ছিল সমরুপ(Homogeneous) কিন্তু এখন বৈচিত্র্যপূর্ণ (Diversive)। হোটেল, পর্যটন স্পট সবই তো সেনাবাহিনী কিংবা প্রশাসনের। স্পটগুলোর উন্নয়নই তারা করছে। যারফলে পাহাড়ি আদিবাসীদের উপর ভয়ানক অর্থনৈতিকভাবে শোষণ চালানো হচ্ছে।

ট্যুরিজম এবং বাঙালির ভোগবাদঃ
ঊনিশ শতকের আগে বা ঊনিশ শতকের প্রথমদিকে বাঙালি সমাজে ভ্রমণ বিষয়টা বনিক, তীর্থযাত্রী, ইতিহাসবিদ এবং উচ্চশিক্ষার্থী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ সুখ বা “Pleasure” বিষয়টা তখন ছিল না। আধুনিক পুঁজিবাদ মুসলিম বাঙালিদের “ভোগ বা Consumption” ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাচ্ছে। আর এই ভোগের অঙ্গ হল “সুখ বা Pleasure। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু করে ম্রো নাচ দেখা সবই বাঙালি সমাজে বিলাসমাত্র। উন্নয়নের জোয়ারে ক্রমশ বেড়ে উঠা মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আকৃষ্ট করার জন্য সেনাবাহিনী নামক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপেক্ষা করে সেইসব অঞ্চলকে পর্যটনের নামে আকর্ষণীয় করে তুলছে প্রতিনিয়ত। প্রত্যেক এলাকায় ট্রাভেল এজেন্সি গড়ে তোলা হয়েছে। এইসব এজেন্সিগুলো যেসব প্যাকেজ ট্যুর, কন্ডাক্ট ট্যুর প্রভৃতি ব্যবস্থা করে দিচ্ছে যেন পর্যটন স্পটগুলো একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন গণপর্যটন বা Mass Tourism। গণপর্যটনের জোয়ারে নিম্ন শ্রেণীর বাঙালিও সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে পাহাড়ে পর্যটনের প্রতি উন্মাদনা তৈরি হচ্ছে। পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া মানেই ম্রো নাচ দেখে বাঙালি পর্যটকদের বিলাসমাত্র।

পাহাড়ি আদিবাসী বনাম ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী বাজারঃ
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় অর্থনীতিতে নিরঙ্কুশভাবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র বা সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত পূঁজিতান্ত্রিক মালিকানা গড়ে উঠে। যা সেনাবাহিনী নামক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবেই ভূমি দখল করে পর্যটন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় স্বাধীনভাবেই কর্পোরেট সংস্থাগুলো তাদের দখলদারিত্ব পরিচালনা করে যাচ্ছে। যা পাহাড়ের বাজার অর্থনীতি থেকে শুরু মালিকানা সবই একচেটিয়া সমতলের বাঙালি আর সেনাবাহিনীর হাতে। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় বৃহৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বলা স্ট্যাবিলাইজিং বা স্থিতিদানকারী সামাজিক স্তর। এরাই ঔপনিবেশিক শাসনের খুঁটি বা পিলার। কোটার সুবিধাসহ প্রভৃতি সুবিধাগুলো দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করে তোলে। যারা বাস্তবে বেতনভোগী ও নানাবিধ সুবিধাভোগী। এ নীতি উপনিবেশগুলোতে প্রয়োগ করা হয়। এই সুবিধাভোগীরা পাহাড়ে বড় ধরণের একটা শ্রেণী করতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র এখানেই সার্থক। যা ভয়াবহ নিপীড়নের মধ্যেও আন্দোলনের ডানা বাঁধে না।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির আদর্শকে সামনে রেখে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ এগিয়ে গিয়েছিল শতাব্দী ধরে। কিন্তু বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ শুরু হয়েছিল তা অনবরত বাধাহীনভাবেই চলছে। বাজার অর্থনীতি থেকে শুরু করে যাবাহনেও বাঙালিদের একচেটিয়া মালিকানা। রাষ্ট্র ঔপনিবেশিকরণে চতুর্দিক থেকে নিপীড়ন জারি রেখেছে এই বর্বর রাষ্ট্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ট্যুরিজম অথবা ডার্ক ট্যুরিজম হল রাষ্ট্রের উপনিবেশিক শাসনের একটা অংশ মাত্র। শাসকগোষ্ঠী তাদের সেনাবাহিনী নামক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাহাড়ের মানুষের উপর জুলুম – নিপীড়ন জারি রাখার জন্যই হাতিয়ার হিসেবে ট্যুরিজম ব্যবহার করছে।

* লেখাটি Denim Chakma এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More