পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটন: আশির্বাদ না অভিশাপ? (১)

0

।। আর এস ত্রিপুরা ।।
বিশ্বে আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতির উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতির কারণে পর্যটন শিল্পের প্রসার নিরন্তর ঘটে চলেছে। আধুনিক পর্যটন, – যা উন্নত দেশগুলোতে জনগণের সকল শ্রেণীর কাছে ক্রমবর্ধমান হারে সহজ লভ্য হচ্ছে,- তার সূচনা হয় প্রধানত মোটরযান, প্রশস্ত রাস্তাঘাট ও হাইওয়ের উন্নতির ফলে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের মধ্যেই কমার্শিয়াল জেট বিমান চালু হওয়ায় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ দ্রুততর হয় এবং পর্যটন শিল্পের বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৭০ দশকের মধ্যে জেট বিমানের উন্নতির ফলে পর্যটনের জন্য বিশ্বের দুয়ার খুলে যায়।[১] এ কারণে অনেকে পর্যটনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প (industry) হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[২]

নাগরিক জীবনের এক ঘেঁয়েমি, শারীরিক ও মানসিক চাপ থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার আশায় অনেকে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, চলে যেতে চান নৈসর্গিক প্রকৃতির কোলে। আর আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে প্রকৃতির দেখা মেলে প্রধানত আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর আবাসভূমিতে। ফলে ইদানিং ethnic tourism, tribal tourism, eco tourism -এর কথা ব্যাপকভাবে শোনা যায়। এখানেই পর্যটনকে ঘিরে আমরা দেখতে পাই সভ্য দুনিয়ার সাথে প্রকৃতির সংযোগ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া।

%e0%a6%a8%e0%a7%80%e0%a6%b2%e0%a6%97%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%bf
# নীলগিরি, বান্দরবান। এখান সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্যটন গড়ে তোলার কারণে মুরং জাতিসত্তার লোকজন উচ্ছেদের শিকার হয়। ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য চট্টগ্রামেও সড়ক ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি এবং দেশে মধ্য বিত্ত শ্রেণীর বিকাশের কারণে পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ হতে শুরু করেছে। কিন্তু পর্যটন সংখ্যালঘু পাহাড়ি জাতিগুলোর আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর কী প্রভাব সৃষ্টি করছে, কারা এই প্রসারমান শিল্প থেকে লাভবান হচ্ছে, সে সম্পর্কে আজো বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। লেখকের বর্তমান নিবন্ধটিও কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিগত গবেষণার ফল নয়। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক খাগড়াছড়ির আলুটিলায় একটি বিশেষ পর্যটন জোন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জনগণের সংগঠিত প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে পর্যটন ইস্যুটি সামনে চলে আসে। এই নিবন্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসীদের উপর পর্যটনের প্রভাবের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে এর ক্ষতিকর দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে পর্যটন বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্ককে উস্কে দেয়ার প্রয়াস করা হয়েছে।

কতিপয় দৃষ্টান্ত
পর্যটন প্রায়শ স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ এবং তাদের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করে। ইতিহাসে সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসীদের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের দৃষ্টান্ত ভরপুর। মালয়েশিয়ার পেনাঙ-এ এবং থাইল্যান্ডের ফুকেট-এ পর্যটনের জন্য সৈকত হোটেল নির্মাণের ফলে সেখানকার মৎস্য সম্প্রদায় উচ্ছেদের শিকার হয়। কানাডায় মোহকদের (Mohawk) কবর স্থানে গলফ মাঠ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গণ বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ায় দ্বীপে ও ইন্দোনেশিয়ার বালিতে পর্যটন ‘রিসোর্ট’ নির্মাণের মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতির কবর স্থানের পরিহানি ঘটানো হয়। আমাজানের গহীন জঙ্গলে অসংবেদনশীল পর্যটন মালিকরা স্থানীয়দের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিঘ্ন ঘটায় এবং আদিবাসীদের মধ্যে টিউবারকিউলোসিস বা ক্ষয় রোগের মতো মারাত্মক পীড়া নিয়ে আসে।[৩]

একশত বছরের অধিক সময় ধরে আমেরিকায় রক্ষিত এলাকা অভয়ারণ্য ও ন্যাশনাল পার্ক সৃষ্টির ফলে আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। যে জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে জমিতে বসবাস করেন ও যে জমি তারা সংরক্ষণ করেন সেখান থেকে তাদের উৎখাত করা হয়। এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। ক্যানিয়ন নামক এলাকায় সংখ্যালঘু হ্যাভাসুপাইদের বসবাস। যুক্তরাষ্ট্রে সকল সংখ্যালঘু জাতি বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো তারাও ট্যুরিজম বা পর্যটনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদেরকে নিজ এলাকা থেকে উচ্ছেদ করে তাদের বংশ পরম্পরার জমির একটি ক্ষুদ্র অংশে জায়গা দেয়া হয়। ১৯১৯ সাল নাগাদ গ্রান্ড ন্যাশনাল ক্যানিয়ন পার্ক গঠনের ফলে তাদের এলাকা মাত্র ৫১৮ একরের মধ্যে সীমিত হয়ে যায়। এ সময় হ্যাভাসুপাইদের ধরে ধরে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়। তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন বিভাগ তাদের পানির কূপগুলো ভরাট করে দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অনেকে মারা যান। বহু বছর ব্যাপী আইনী লড়াইয়ের পর ১৯৭৪ সালে হ্যাভাসুপাইরা তাদের পূর্বতন জমির কিছু অংশ ফিরে পায়। গ্রান্ড ক্যানিয়নে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ দর্শণার্থী আসেন। তাদের একটি অংশ ২০,০০০ দর্শনার্থী হ্যাভাসুপাইদের সংরক্ষিত এলাকায় যান। এজন্য প্রতি দর্শনার্থীকে ১৫ ডলার দিতে হয়। এ অর্থ হ্যাভাসুপাইদের তহবিলে যোগ হয় এবং তা তাদের পুরো সম্প্রদায়ের জন্য খরচ করা হয়। পর্যটন এভাবে হ্যাভাসুপাইদেরকে চিড়িয়াখানার জন্তুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এখনো তাদেরকে পর্যটনের তীব্র প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। হেলিকপ্টার ও বিমান থেকে সৃষ্ট শব্দ দূষণ, আবর্জনা, ভূমিক্ষয়, বন্য প্রাণীর সঙ্গীন অবস্থা ইত্যাদি হলো বর্তমানে তাদের এলাকার পর্যটনের নেতিবাচক ফল।[৪]

lanyu_2

তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা
জু-মিং লি এবং দউ-জাইয়ি লু নামে দুই গবেষক তাইওয়ানের অর্কিড দ্বীপে (Orchid Island) তাও জাতিসত্তার উপর পর্যটনের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে তাওদের ধর্ম-বিশ্বাস বা কুসংস্কার ও সামাজিক আচার প্রথা, সংস্কৃতি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছে এবং পর্যটনের প্রভাবে সে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং সে সব বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। তারা লেখেন, অর্কিড দ্বীপের প্রাণ-পরিবেশ ও তাও জাতিসত্তার সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে হয়, এক শ্রেণীর পেঁচা, প্রজাপতি ও কাঁকড়া তাইওয়ানের এই তিন প্রজাতির সংরক্ষিত বন্য প্রাণীর উপর পর্যটনের প্রভাব তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট। এই তিন প্রাণী তাও জাতিসত্তার সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং তারা ঐতিহ্যগত প্রাণ সম্পদের নির্দেশক। শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সংস্কারের কারণে তাও জাতিসত্তার লোকজন এই প্রাণীগুলোকে শিকার বা সংগ্রহ করে না। এই তিন প্রজাতির প্রাণীগুলোর সংখ্যা কমে যাওয়ায় তাদের এখন সংরক্ষিত করা হয়েছে। অর্কিড দ্বীপটি পর্যটনের জন্য খুলে দেয়ার পর থেকে এই পরিবর্তন সংঘটিত হয়।[৫]

তাইওয়ানের জাতীয় সরকারের আমলে সেনাবাহিনী অর্কিড দ্বীপে পর্যটকের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৬৭ সালে কেই-ইউয়ান (Kaiyuan) বন্দর সরকারীভাবে খুলে দেয়া হয় এবং এর ফলে পর্যটন শুরু হয়। ১৯৭০ সালে অর্কিড দ্বীপে আকাশ পথ খুলে দেয়া হলে পর্যটন বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। উল্লেখ্য, তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েন সম্প্রতি সে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপর অতীতের নিপীড়ন নির্যাতনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং তাদের জমি ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাইওয়ানে সরকারীভাবে স্বীকৃত ১৪টি জাতিসত্তা রয়েছে।[৬]  … চলবে

[1] ‘Modern tourism, increasingly available to all classes of people in “developed countries”, began in large part with the development of the automobile and expanded road and highway systems. By the middle of this century (20th century) the development of commercial jet airlines enabled fast international travel and the tourism industry exploded. By the 1970s improvement of jet aircraft opend up the world to the tourism boom.’  The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[2] Globalization, Tourism and Indigenous peoples: What you should know about the world’s largest industry, by Lee Pera and Deborah Mclaren, 1999.

[3] ‘The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[4] ’  The History of Indigenous Peoples and Tourism, https://www.culturalsurvival.org/ourpublications/csq/article/the-history-indigenous-peoples-and-tourism

[5] ÔÔWith a respect to the ecology of Orchid Island and the culture of the Tao tribe, the impacts of tourism on the three protected wild animal species of Taiwan, including Elegant Scops owls, Birdwing butterflies, and coconut crabs, are relatively apparrent. These three animals play important roles in the culture of the Tao tribe and are indicators of the traditional biological resources. The strong cultural taboo strictly prohibits members of the Tao tribe from hunting and collecting these; however, these three species have become protected because their population numbers continue to decrease. Thier change occured after Orchid Island was opened for tourism” The culture and ecological impacts of aboriginal tourism: a case study on Taiwan’s Tao tribe, http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4117854/

[6]New Age, August 2, 2016
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More