পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবাদী শক্তিকে দমিয়ে রাখতে সরকারের অপকৌশল

0

।। পারদর্শী ।।
বাংলাদেশের চিরনিপীড়িত অঞ্চলের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন শাসকচক্র এ অঞ্চলের উপর জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। যা আজো চলমান। এখানে নিয়োজিত করা আছে বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী। সরকার এক সময় এ অঞ্চলে শান্তিবাহিনীকে প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে মনে করতো। যার কারণে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি জারি করে বর্বর দমন-পীড়ন চালিয়েছিলো। এমন কোন পাহাড়ি নেই সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়নি। এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে সরকার পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিলো। লড়াইরত শান্তিবাহিনীকে সন্ত্রাসী, রাষ্ট্রবিরোধী তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের পক্ষে সেটা দমন করা সম্ভব হয়নি।

সেনাবাহনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৮৯ সালে  ৪ মে লংগদু গণহত্যা সংঘটিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শুরু হয় রাজপথের আন্দোলনের পর্যায়। গঠিত হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। এর ফলে দেশে-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়নের চিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যা অতীতে সেভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

এমতাবস্থায়, ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে শান্তিবাহিনী নামের প্রতিবাদী শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয় সরকার।  যেভাবেই হোক প্রতিবাদী শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করতে পারাই ছিল সরকারের কৌশল।  কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতিকে নিষ্ক্রিয় করতে পারলেও, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে যে শক্তি গড়ে উঠেছে, সে শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। এই শক্তির বৃহৎ একটি অংশ সরকারের কূটচাল বুঝতে পেরে যে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিরোধ শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হলো, সে চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলে। যে শক্তি পরে ইউপিডিএফ নামে একটি দল গঠন করে এবং লড়াই অব্যাহত রাখতে সংকল্পবদ্ধ হয়।

সরকার চেয়েছে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়ে ভূমি বেদখলের মাধ্যমে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা, বেআইনীভাবে বাঙালি পুনর্বাসনের মাধ্যমে পাহাড়িদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা। সেই পরিকল্পনা মাফিক সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে রাস্তাঘাট নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন সহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাহাড়িদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। এসবের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে টিকে রয়েছে ইউপিডিএফ নামের দলটি।  এ দলটি ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন সহ প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যা সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, চুক্তি পক্ষের শক্তি হিসেবে জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি ছাড়া সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদ করছে না। সরকারও চায় যাতে কোন প্রতিবাদ গড়ে না উঠুক। প্রতিবাদ গড়ে না উঠলে তো সরকারেরই লাভ।

তাই, প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে টিকে থাকা ইউপিডিএফকে গলাটিপে ধরে কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে হয়। সেই চিন্তা থেকেই সরকার ইউপিডিএফের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ইউপিডিএফকে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে। অন্যায়ভাবে নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় করে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ, গণতান্ত্রিক মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া ইত্যাদি বর্তমানে ইউপিডিএফের উপর জারি রাখা হয়েছে।  সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিবাদী শক্তিকে জোরপূর্বক দমিয়ে রাখা, যাতে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে। যার কারণে সরকার সেনাবাহিনী ছাড়াও সন্তু লারমা ও তার পরিচালিত জেএসএসকে ব্যবহার করছে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে।  সন্তু লারমাকে ব্যবহার করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। পাহাড়িদের মধ্যেকার ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত, অনৈক্যকে পুঁজি করে সরকার একের পর এক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে ভূমি বেদখল, বিজিবি-সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণ, সেটলার অনুপ্রবেশ, সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ইত্যাদি।

সরকার যে কারণে প্রতিবাদী শক্তিকে দমন করতে চায় তা হলো- পার্বত্য চট্টগ্রামে যা ইচ্ছা তা-ই করা, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, সেটলার অনুপ্রবেশ নির্বিঘ্ন করা, জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে কোনঠাসা করে রাখা এবং সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাশালী করে তোলা।

সরকার মনে করছে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে লিজ নিয়েছে। তাই যাচ্ছেতাইভাবে ভোগ করে যাবে। যদি কোন প্রতিবাদী শক্তি না থাকে তাহলে সরকার তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে না। সরকারতো চাচ্ছে সেটাই।

কাজেই, পাহাড়ি জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি সরকারের অন্যায়-অবিচার মাথা পেতে নেবো, নাকি প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।

২৯.০৫.২০১৫

[মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখকের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত]
———————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More