বিশেষ সম্পাদকীয়

পার্বত্য চট্টগ্রামে বন রক্ষা জরুরী

0

পার্বত্য চট্টগ্রামে বনের সাথে পাহাড়ি জনগণের সম্পর্ক হলো নাড়ীর। বনকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবন আবর্তিত। বন ছাড়া তাদের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারে না, বন ছাড়াও তেমনি পাহাড়িরা টিকতে পারে না। এ কারণে বলা যেতে পারে, যে অনুপাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ধ্বংস করা হয়েছে, ঠিক সেই অনুপাতে তাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রাক-বৃটিশ যুগে এখানে বন ছিল সুরক্ষিত, তাই পাহাড়ি জাতিগুলোও ছিল কার্যত স্বাধীন। কিন্তু পরে বৃটিশ আধিপত্য ও উপনিবেশ কায়েম হলে বনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে এবং তাদের জাতীয় অস্তিত্বের উপর হুমকিও তখন থেকেই দেখা দিতে শুরু করে। এরপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তাদের এই নিয়ন্ত্রণ আরো বেশী খর্ব হয়, বনের সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা আরো বেশী বেড়ে যায় এবং সেই অনুপাতে গভীর হয় তাদের অস্তিত্বের সংকট।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ধ্বংসের বহু প্রক্রিয়া জারী রয়েছে। তার মধ্যে দু’টি হলো পর্যটন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ। এই দু’টি কার্যক্রম যে বন ধ্বংসের জন্য দায়ী সে ব্যাপারে নতুন করে প্রমাণ দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সরকারী ও বেসরকারী গবেষণায় এই কথার সত্যতা মিলেছে। কিন্তু তারপরও সরকার পাহাড়ি জনগণের মতামতের কোনরূপ তোয়াক্কা না করে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির স্বার্থে পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং যত্রতত্র রাস্তাঘাট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। রাঙামাটির সাজেকে শিজকছড়া থেকে ভারতের মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার, খাগড়াছড়ি জেলায় বাবুছড়ার ধনপাদা থেকে নারেইছড়ি এবং নারেইছড়ি থেকে পানছড়ি পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণের কাজ এখন জোরেশোরে চলছে। গভীর বনের ভেতর দিয়ে এই রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই রাস্তাগুলো তৈরির কাজ শেষ হলে তার কয়েক বছরের মধ্যেই এসব এলাকার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল উজার হয়ে যাবে।

অপরদিকে পর্যটনের বিস্তার ঘটানোর জন্য বান্দরবানে একটি পাঁচ তারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক এবং রাঙামাটির সাজেকে একটি বাঁধ দেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। উভয় প্রকল্পের ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের প্রবল আপত্তি রয়েছে, কারণ এতে তারা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবেন, জমিজমা হারাবেন এবং বনের উপর তাদের যৌথ অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবেন। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের যেখানে হোটেলটি নির্মাণের কাজ চলছে সেখানে ও তার আশেপাশের বনে ম্রোদের ফুল ঝাড়ু কুড়োতে বাধা দেয়ার খবর ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়েছে।

এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, শাসকগোষ্ঠী বন থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন ও বনের উপর তাদের বংশপরম্পরাগত অধিকার খর্ব করার জন্য একটি কাল্পনিক ও খোঁড়া যুক্তি হাজির করে থাকে। তা হলো জুম চাষ বন ধ্বংসের জন্য দায়ী। অর্থাৎ সরকারের যুক্তি ঈষৎ ব্যাখ্যা করলে যা দাঁড়ায় তা হলো- অনিয়ন্ত্রিত গাছ ব্যবসা, বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সির নামে রাস্তার দু’পাশের গাছ কর্তন ও অন্যান্য কার্যক্রম, পর্যটন,  রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চার লক্ষাধিক বহিরাগত বাঙালিকে পুনর্বাসন করে জনসংখ্যার নাটকীয় বৃদ্ধি ঘটানো, উন্নয়নের নামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ও পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ি নয়, যারা শত শত বছর ধরে বনকে আগলে রেখেছে, রক্ষা করেছে ও বনকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে তারাই হলো বন ধ্বংসের জন্য দায়ি!

এটা ঠিক জুম চাষের জন্য কিছু গাছপালা বা বন সাফ করতে হয়। আর এই সাফ করার কাজটা চাক্ষুষ দেখা যায় বলে বন ধ্বংসের জন্য জুম চাষকে দায়ি করা হলে অনেকের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে জুম চাষের জন্য স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিমাণ বন সাফ করার প্রয়োজন হলেও সামগ্রিকভাবে বন ও পরিবেশ ধ্বংসের জন্য জুম চাষ আদৌ দায়ি নয়। কারণ জুমের জন্য যে বন কাটা বা ধ্বংস করা হয় তা হলো সাময়িক সময়ের জন্য, স্থায়ীভাবে ধ্বংস করা হয় না। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিকভাবে সেখানে আরও বন গড়ে ওঠে। যদি তা না হতো, অর্থাৎ জুমের সিস্টেমটা যদি এমন না হতো, তাহলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা জুম চাষের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন বহু আগে অর্থাৎ বৃটিশদের আগমনের আগেই শেষ হয়ে যেতো। অথচ আমরা জানি এই অঞ্চলে বন ধ্বংসের কাহিনী শুরু কেবল ইদানিং কালে।

আসলে বন ধ্বংসের কারণ জুম নয়, অন্য কিছু, যা উপরে আভাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তাদের হীন স্বার্থে সেই সত্য কখনও স্বীকার করতে ও দেশবাসীকে জানতে দিতে চায় না। জুম চাষ বরং বনকেই রক্ষা করেছে। কারণ জুম চাষের জন্য বন দরকার। বন ছাড়া জুম চাষ করা যায় না। যেখানে বন নেই, সেখানে জুম চাষ নেই এবং সেখানে পাহাড়িও নেই। এ কারণে পাহাড়িরা নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই বনকে রক্ষা করে থাকে।

সরকার দেশে বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য অঙ্গীকার করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার অনেক কার্যক্রম বন রক্ষার পরিবর্তে বন ধ্বংসেরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হয় তাহলে তাকে অবশ্যই উপরোল্লেখিত রাস্তা নির্মাণ ও পর্যটন সম্পর্কিত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ করতে হবে।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More