পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন আর কত দিন চলবে?
॥ মন্তব্য প্রতিবেদন ॥
গতকাল ২০ মে ছিল বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে দীঘিনালার বানছড়া হাই স্কুল মাঠে একটি ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। প্রশাসনকে উক্ত অনুষ্ঠান বিষয়ে যথারীতি অবহিতও করা হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানের একদিন আগে অর্থাৎ ১৯ মে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালা জোনের সেনা সদস্যরা স্কুল মাঠে এসে বাঙলা ফিল্মের ভিলেনের অনুগত মাস্তান বাহিনীর মতো চারদিক ঘিরে ফেলে এবং মঞ্চ তৈরির সরঞ্জাম নষ্ট করে দেয় ও পিসিপির নেতাকর্মীদের সেখান থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয়। তারা সেখানে পিসিপির কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না বলে জানায়। সেনাবাহিনী পরদিন অর্থাৎ ২০ মে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। পুলিশের একটি দলকেও সেনারা পরে সেখানে নিয়ে আসে।
এই ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২০ মে সকাল ৮:১২টায় খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে পিসিপিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি দেয়া হবে না এই মর্মে একটি চিঠি দেয়া হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার দেওয়ান মওদুদ আহমেদ স্বাক্ষরিত উক্ত চিঠিতে বলা হয়, অনুষ্ঠান বিষয়ে পিসিপির ১১ মে তারিখের চিঠির প্রেক্ষিতে জেলা পুলিশ সুপারের কাছ থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হয়, পুলিশ সুপার তার প্রতিবেদনে পিসিপিকে “একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি-বিহীন এবং আঞ্চলিক ছাত্র সংগঠন” হিসেবে উল্লেখ করেন। উক্ত প্রতিবেদনের উদ্বৃতি দিয়ে জেলা প্রশাসনের চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, “প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।”
এরপর উপসংহার কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। চিঠির শেষে বলা হয়, “এমতাবস্থায়, উক্ত প্রতিবেদনের আলোকে যে কোন প্রকার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো এবং সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে কোন প্রকার দেয়াল লিখন, ছাত্র সমাবেশ ও র্যালির অনুমতি প্রদান করা গেল না।”
রাষ্ট্রীয় শক্তির যথেচ্ছ অপব্যবহারের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এর চাইতে আর কিছুই হতে পারে না। জেলা প্রশাসনের উক্ত চিঠি সম্পর্কে আমরা এখানে দু’একটি মতামত সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরতে চাই। প্রথমত, সমাবেশ স্থলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করার কোন কারণ কোন অবস্থায়ই বিরাজমান ছিল না, থাকার কথাও নয়। কারণ ঐ এলাকাটি একটি পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকা, দীঘিনালা সদর থেকে আনুমানিক ৪ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পাল্টা সমাবেশও অন্য কোন সংগঠন আহ্বান করেনি। দ্বিতীয়ত, নাশকতামূলক কার্যকলাপের আশঙ্কাও নিতান্তই অমূলক। কিসের ভিত্তিতে এই আশঙ্কার কথা বলা হলো তা পিসিপিকে জানানো উচিত ছিল। নাশকতার আশঙ্কা যদি সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে প্রশাসনের উচিত ছিল পিসিপির সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকার বলবৎ করার জন্য প্রয়োজনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করা। যেমনটা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ থেকে আশা করা হয়। কিন্তু প্রশাসন সেটা না করে কাল্পনিক নাশকতার আশঙ্কার অজুহাতে পিসিপির মৌলিক নাগরিক অধিকারকেই হরণ করেছে। জেলা প্রশাসনের মনে রাখা দরকার তার কাজ কেবল আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা নয়, নাগরিকরা যাতে তাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার নিশ্চিন্তে ভোগ করতে পারে তারও নিশ্চয়তা বিধান করা।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। আর তা হলো, পিসিপি ও অন্যান্য পাহাড়ি সংগঠনগুলো যখন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে যায় তখনই কেবল প্রশাসন ও সরকারী গোয়েন্দারা ‘নাশকতা’ ও ‘আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত’ হওয়ার আশঙ্কা দেখতে পায়। আর যখন মহাজন পাড়ায় কয়েকদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়ে হামলা চালানো হয়, সাজেকে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, যত্র তত্র ভূমি বেদখল হয়, তখন তারা কিছুই দেখতে পায় না, কিছুই জানে না। তখন তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। প্রশাসন এভাবে এক চোখ বন্ধ করে আর কতদিন থাকবে?
তৃতীয়ত, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সেনাবাহিনী সমাবেশ স্থলে হামলা চালানোর পরই জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পিসিপির কাছে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। কাজেই এটা পরিস্কার যে, সিভিল প্রশাসনের নির্দেশে আর্মিরা ঐ কাজ করেনি। বরং দৃশ্যত আর্মিদের নির্দেশেই জেলা প্রশাসন অনুষ্ঠানের অনুমতি না দিয়ে চিঠি ইস্যু করতে বাধ্য হয়েছে। আরও কথা আছে, চিঠি পাওয়ার পরও যদি পিসিপি প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে নির্ধারিত স্থানে সমাবেশের প্রস্তুতি নিতো, তাহলেই কেবল প্রশাসন শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। আর শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন যদি দেখা দেয়, তাহলে তার নিজস্ব পুলিশ বাহিনী রয়েছে। পুলিশই প্রশাসনের নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নামবে। কিন্তু দীঘিনালার ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো, সেনাবাহিনীই সেখানে আগ বাড়িয়ে আইনের তায়াক্কা না করে সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক নাগরিক অধিকারের উপর অন্যায় ও অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে।
কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। দীঘিনালায় পিসিপির কর্মসূচীতে সেনাবাহিনীর বাধা প্রদান নতুন ঘটনা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অনেক পুরোনো, অনেক তিক্ত। এ কারণে পিসিপির এবারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পোস্টারের থিম করা হয়েছে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে। উক্ত পোস্টারে যে ছবি আঁকা হয়েছে তাতে দেখা যায় এক ছাত্র প্ল্যাকার্ড বহন করছে, আর তাতে লেখা আছে ‘সেনা শাসন বন্ধ কর’। আমরাও চাই পার্বত্য চট্টগ্রামে অবিলম্বে সেনাশাসন বন্ধ করা হোক এবং পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। এটা সবার তথা দেশ ও জাতির মঙ্গলের স্বার্থে একান্তই প্রয়োজন। #
——————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।