বিবিসি’র প্রতিবেদন

পার্বত্য চট্টগ্রাম: বান্দরবানে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ নিয়ে ম্রো সম্প্রদায়ের উদ্বেগ

0
পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছেন সেখানে বসবাসরত ম্রো সম্প্রদায়। ছবি: বিবিসি

সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে একটি পাঁচতারা রিসোর্টের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করেছেন সেখানে বসবাসরত ম্রো সম্প্রদায়। এ রিসোর্টটি নির্মাণ করছে সিকদার গ্রুপ ও সেনা কল্যাণ সংস্থা।

চিম্বুক পাহাড় এলাকায় নাইতং পাহাড় নামে পরিচিত স্থানটিতে রিসোর্ট তৈরির জন্য ২০ একর জমি সেনাবাহিনীকে ইজারা দিয়েছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন। স্থানীয় ম্রো অধিবাসীদের দাবি, তাদেরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এ জমি ইজারা দেয়ার সম্মতি আদায় করা হয়েছিল।

চিম্বুক পাহাড়ের কাপ্রুপাড়ার বাসিন্দা তাং লেং ম্রো। ৫০ বছর ধরে সেখানে থাকা এ নারী বলেন, জেলা পরিষদ বাগান করার কথা বলে জায়গাগুলো নিয়েছে। তারা বাগান করতে চাইলে সেটাও আমাদের ইচ্ছাতেই হউক। কিন্তু কোনভাবেই পর্যটন চাই না।

বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে থাকা ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রধান জীবিকা জুম চাষ। এ জুম চাষের জমি দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন তারা।

কাপ্রুপাড়ার জুম চাষী লং নান ম্রো বলেন, যেখানে রিসোর্ট বানাচ্ছে তার চারধারে এখনই আমাদের যেতে দিচ্ছে না। এখনই আমাদের জুম চাষ করার জায়গা নাই, হোটেল হলে তো আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে।

ম্রো জনপদে উচ্ছেদ আতংক কেন?

বান্দরবানের চিম্বুক-থানচি সড়কের পাশে ২০ একর জমিতে ‘ম্যারিয়ট-চন্দ্রপাহাড় রিসোর্ট আ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ নামে এ পাঁচতারা রিসোর্ট নির্মাণ করছে সিকদার গ্রুপের আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস ও সেনা কল্যাণ সংস্থা।

সেখান থেকে নীলগিরি আর্মি রিসোর্ট পর্যন্ত ক্যাবল কার চালুর পরিকল্পনাও আছে তাদের।

আর আন্দোলনকারীরা বলছেন, শুধু ২০ একর নয়, এসব স্থাপনার কারণে প্রকৃতপক্ষে ১ হাজার একর জমি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১০ হাজার মানুষ।

আন্দোলনকারীদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেং ইয়ং ম্রো। তিনি এখন নিরাপত্তাজনিত কারণে আত্মগোপন করে আছেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, হোটেল ২০ একরের হলেও এখনই তারা এর চেয়েও বেশি এলাকাজুড়ে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। তারা যে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে ক্যাবল কার বানাবে, সে স্টেশনগুলি তো এই ২০ একরের হিসাবের বাইরে।

তাছাড়া হোটেল ও বিনোদন পার্কে বহিরাগতদের আগমনের কারণে ম্রো নারীরা নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বেন বলেও মনে করেন আন্দোলনকারীরা।

তবে এসব আশংকা একেবারেই অমূলক বলে দাবি সিকদার গ্রুপের।

তাদের দাবি, ওই এলাকার দশ কিলোমিটার জুড়ে কোনো জনবসতি নেই। কখনো ছিল না। সেখানে পর্যটনের বিকাশ হলে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এমনটাও বলছেন তারা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ইজারা দেয় কারা?

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি মালিকানা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীভিত্তিক, সমতলের মত ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। ফলে সেখানকার ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া সমতলের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন।

নির্মাণাধীণ রিসোর্টের জায়গা ইজারা দেয়া নিয়ে নানা বিতর্কের মুখে সংবাদ সম্মেলন করে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ।

এর চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্ল সেখানে বলেন, স্থানীয় পর্যটন বিকাশের খাতিরে ওই জমি তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ১৮ টি শর্তে ইজারা দিয়েছেন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর সদস্য কে এস মং বলছেন, আইনগতভাবে পর্যটন শিল্পের কোনো স্থাপনা গড়ে তুলতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। ওই জমির বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার জন্য বান্দরবানের ডিসি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। সেটা নাকচ করা হয়।

এরপরেও সেখানে রিসোর্ট তৈরির কাজ শুরু হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন জনসংহতি সমিতির এই নেতা।

মি. মং বলেন, সরকারের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, সেনাবাহিনী–তারা যদি আইন না মানে, তাহলে আমরা কী বলবো বলুন?

অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বান্দরবানের এক সেনা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, এখানে তৃতীয় কোন পক্ষ ম্রো সম্প্রদায়কে ভুল বুঝিয়ে আন্দোলন করিয়েছে। তারা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।

এই কর্মকর্তা দাবি করেন তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রীসহ ম্রো জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল কাপ্রুপাড়ায় গিয়ে তাদের বুঝিয়েছেন। সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি শিগগিরই সমাধান হবে বলেই মনে করছেন তিনি।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এভাবে জমি ইজারা নেয়ার বিষয়টি একেবারেই অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চ-এর সমন্বয়ক এই আইনজীবী বলেন, পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারীদের সচেতনতার অভাব আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জোরালো কোনো ভূমিকা না থাকায় এ অঞ্চলের বহু জমি সেনা ক্যাম্প কিংবা পর্যটন করার নামে ইতোমধ্যেই বেদখল হয়ে গেছে।

আর এসব কারণে এ অঞ্চলে বসবাসকারীদের সাধারণ জীবনযাত্রা মারাত্মক হুমকির মুখে বলে মনে করেন তিনি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ

উচ্ছেদ আশঙ্কায় থাকা ম্রো জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ওমর ওয়ারাইচ লেখেন, অবিলম্বে সরকারকে এ বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছি।

ভবিষ্যতে কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত সম্মতি গ্রহণের আহ্বানও জানানো হয়েছে ওই চিঠিতে।

চিটাগাং হিল ট্র্যাকস কমিশনও এ প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে।

এ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং-এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবিসি-র সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে চান না বলে জানান।

এদিকে, হোটেল ম্যারিয়টের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবিতে ৮ই নভেম্বর ম্রো জনগোষ্ঠী একটি সমাবেশ করে। সেখানে ৫ দিনের মধ্যে নির্মাণকাজ বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন তারা।

তবে ওই রিসোর্টের নির্মাণকাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে বলেই জানিয়েছেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত/প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More