পাহাড় আচ্ছন্ন তামাকের নেশায়

0
-মৃত্যুঞ্জয় রায়
 
বান্দরবান শহর থেকে রুমা যাওয়ার পথ ধরলাম। সাঙ্গু নদীর কাছাকাছি যেতেই পাহাড়ের ঢালে বিশেষ করে ছড়াগুলোর দু’পাড়ে, সাঙ্গু নদীর বিস্তীর্ণ পাড় ধরে চোখে পড়ল কেবল তামাক আর তামাকের ক্ষেত। থানচি যেতেও তাই। দশ-পনের বছর আগে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা ছিল জুম চাষ, ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ জুমের কাজে নিয়োজিত থাকত, তাদের এখন প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ঝুঁকে পড়েছে তামাক চাষে। কেননা, তামাকের মতো নগদ প্রাপ্তি জুম চাষে নেই। তাই দিন দিনই জুমের জমি কমছে, বাড়ছে তামাকের জমি। এতে একদিকে যেমন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে, তেমনি বিপন্ন হচ্ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৯০টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে তামাকের চাষ হচ্ছে। এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে এই বৃদ্ধির হার বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। পঞ্চাশের দশকে ৩০ শতাংশ তামাক উপাদন হতো এসব অঞ্চলে, বিগত শতাব্দীর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশে। সেই বাতাস লেগেছে বাংলাদেশেও। বান্দরবানে গত ১৯৯৫-৯৬ সালে তামাক চাষ হয়েছিল মাত্র ২৭ হেক্টর জমিতে। সেখানে ১২ বছর পর তামাক চাষ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৩৭ হেক্টর। পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে তামাক চাষের আগ্রাসনটা বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণ হল, দিন দিন পাহাড়ে মানুষ বাড়ছে। সনাতন প্রথার জুম চাষের জমি সংকুচিত হয়ে আসছে। তা ছাড়া জুমের উপাদন বেশ কম। শুধু জুমের ওপর নির্ভর করে এখন আর ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ বাঁচতে পারছে না। অন্যদিকে, স্বল্প জীবনকালের তামাক চাষে আয় আসছে বেশি। নগদ টাকা পেয়ে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের জীবনধারা বদলে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে অনেকেই এখন তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

জুম চাষ বনাম তামাক চাষ : ২০০০ সালের আগে মারমা সম্প্রদায়ের শতভাগ লোক জুম চাষ করত। তাদের পরিবারপ্রতি জুম চাষের গড় জমির পরিমাণ ছিল ১.৫ হেক্টর। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.৬ হেক্টরে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই করছে তামাক চাষ। পরিবারপ্রতি এখন প্রায় ১.৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ করছে। ৭ থেকে ৯ বছর আগে তারা এ চাষ শুরু করেছিল বলে জানা যায়। এর পেছনে দুটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছে তারা। এক, দিন দিন জুম থেকে আয় কমে আসছে। দুই, তামাক চাষে লাভ বেশি হচ্ছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কাছে এই লাভ বেশি মনে হলেও অনুসন্ধানে দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে জুমেই তাদের লাভ বেশি। কেননা, জুম চাষে খরচ খুব কম, উপকরণ তেমন লাগে না বললেই চলে। অন্যদিকে তামাক চাষে উপকরণ ও শ্রমিক খরচ জুমের চেয়ে অনেক বেশি। এক হেক্টরে জুম চাষ করতে যেখানে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর খরচ পড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা, সেখানে সেই পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করতে খরচ পড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। পক্ষান্তরে, একই পরিমাণ জমি থেকে যথাক্রমে জুম চাষে আয় হয় প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা এবং তামাক চাষে আসে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা।

শস্যধারার পরিবর্তন, জীবনের জন্য হুমকি : তামাক চাষ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শস্যধারা ও জীবনধারায় পরিবর্তন এসেছে। দশ-পনের বছর আগেও যেসব জুমে তারা ৩২ রকমের ফসল চাষ করত সেখানে এখন তারা নিতান্ত প্রয়োজনীয় মুষ্টিমেয় কয়েকটা ফসলের চাষ করছে। যেসব জমিতে প্রচুর শাক-সবজির চাষ হতো, সেসব জমিতে এখন তামাক চাষ হচ্ছে। ফলে শাক-সবজির দাম বাড়ছে, প্রাপ্যতা কমছে এবং পুষ্টিসংকট তৈরি হচ্ছে। আগে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বলতে গেলে বাজার থেকে কোনও খাবারই কিনতে হতো না। এখন প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নিজেরা নিজেদের কোনও খাদ্যই উপাদন করে না, সম্পূর্ণই বাজারের ওপর নির্ভর করে।

তামাক চাষ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি : দশ বছর আগেও শতভাগ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ জুম চাষের জন্য নিজেরাই নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করত। কিন্তু বর্তমানে শস্যধারায় পরিবর্তন আসায় তারা আর বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজন মনে করছে না। এক জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে ৯২ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ জুম চাষের জন্য এখন আর কোনও ফসলের বীজ মজুদ করে না। জুম চাষের জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ বাজার ও পড়শিদের কাছ থেকে বীজ নেয়। এতে অতীতের সেসব জুম ফসলের কৌলি সম্পদ আর তাদের ঘরে থাকছে না। প্রকারান্তরে দেশ হারাচ্ছে মূল্যবান জেনেটিক রিসোর্স। অন্যদিকে, তামাক চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যে জমিতে তামাক চাষ হয় সে জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে, মাটিতে থাকা কেঁচোসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রাণীর সংখ্যা কমে যায়, মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং তামাকের জমিতে পরবর্তীতে অন্য ফসল আর ভালো হতে চায় না। এমনকী ধান চাষ করলেও সেসব ধানের পাকতে সমস্যা হয়। এখন পার্বত্য গ্রামের অনেক জায়গায় তামাক পাতা কিউরিংয়ের জন্য কিউরিং হাউস তৈরি করা হয়েছে। সেসব কিউরিং ঘরে জ্বালানির জন্য নির্বিচারে পাহাড়ের গাছ কাটা হচ্ছে। পরিবেশের প্রতি এ বিষয়টিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সব মিলিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে পাহাড়ের তামাক চাষ নিয়ে।

লেখক : পরিবেশ ও কৃষিবিদ

 
 
 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More