প্রতিশ্রুতি আর কত দিন?

0

॥ রাজনৈতিক ভাষ্যকার ॥
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ঢাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সের ভিত্তি ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেছেন, পাহাড়ে চারটি ব্রিগেড ছাড়া বাকি সব সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতি নতুন নয়। ইতিপূর্বে তিনি অসংখ্যবার এ ধরনের বুলিসর্বস্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

Commentaryকয়েক বছর আগে (খুব সম্ভবত ২০১২ সালে) তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির মালিক হবেন পাহাড়ি জনগণ। অথচ পরিহাস হলো, পাহাড়িরা জমির মালিক হওয়ার বদলে নানাভাবে জমি হারাচ্ছে, নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। অপরদিকে প্রতিদিন পাহাড়ে বহিরাগত বাঙালির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে পাহাড়িরা দিন দিন নিজ ভূমিতে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। যেখানে ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ, এখন সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান। তবে অব্যাহত বহিরাগত অনুপ্রবেশ ও বাঙালিদের উচ্চ জন্মহার বিবেচনায় নিলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই অনুপাতও দীর্ঘ দিন বজায় থাকবে না; বরং অচিরে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও বাঙালিদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েম হবে এবং পাহাড়িদের অবস্থা আরো বেশী সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে বাঙালিরা তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার মধ্যে কমপক্ষে ৮টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এছাড়া তিন জেলা সদরসহ যে কয়টি পৌরসভা রয়েছে তার সব কটিতে বাঙালিরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমনকি কোন কোন পৌরসভায় পাহাড়ি ভোটারের সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র। এ সব পৌর সভার নির্বাচনে পাহাড়িরা নিজেদের প্রার্থী দেয়ার কথা পর্যন্ত চিন্তা করতে পারে না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের এই অবস্থান তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কল্যাণে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তাতে পাহাড়ি জাতিসমূহের কোন অংশীদারীত্ব নেই। বরং নতুন রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তাদেরকে বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে — হয় বাঙালি হয়ে যাও, না হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাও এই ছিল রাষ্ট্রীয় নীতি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও এই নীতির পরিবর্তন হয়নি। বরং নতুন করে সংবিধানে এই নীতির প্রকাশ্য প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে বলা হয়েছে: “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” পাহাড়িরা যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের অংশ, তাই সাংবিধানিকভাবে তারা ‘জাতি হিসেবে বাঙালি’ বলে পরিচিত হতে বাধ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংবিধান বা রাষ্ট্র কি জোর জবরদস্তি করে কোন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা গারো, মুনিপুরী, সাঁওতাল ইত্যাদি সংখ্যালঘু জাতির জনগণকে নিজ জাতীয় পরিচয় ত্যাগ করে বাঙালি বলে নিজেদেরকে পরিচয় দিতে বাধ্য করতে পারে?PM-Hasina-new-m120160508155640

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত সংখ্যালঘু জাতিসমূহের আত্ম পরিচিতির অধিকার কেড়ে না নিয়ে দেশে সকল জাতির সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। একটি দেশে বিভিন্ন জাতির বাস থাকলে তাদের বিকাশের স্তর ভিন্ন হতে দেখা যায়। কোন একটি জাতি নানা ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে পিছনে পড়ে থাকলে অর্থাৎ জাতি হিসেবে বিকাশের নিচের স্তরে পড়ে থাকলে অগ্রসর জাতির উচিত সেই জাতিকে বিকশিত হতে সাহায্য করা। জাতির কথা বাদ, একটি পরিবারের মধ্যেও সবার বিকাশ সমান নয়। পরিবারে বড়রা সব সময় ছোটদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করে থাকে। প্রয়োজনে অনেক কিছু সেকরিফাইস করে। এটাই নিয়ম। সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এ রকমই হয়ে থাকে। সে জন্য দেখা যায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমনকি চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশেও সংখ্যালঘু জাতির জনগণ ব্যাপক অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।

যাই হোক, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এখন নয়। আমরা আশা করবো প্রধানমন্ত্রী তার কথা রাখবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবিলম্বে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে নেবেন। তবে শুধু ক্যাম্প প্রত্যাহার যথেষ্ট নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ এর নামে যে অঘোষিত সেনা শাসন চলছে তারও দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে এবং বেদখলকৃত জমি ফিরিয়ে দিতে হবে। নচেৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। #
—————

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More