বগাছড়িতে সেটলার হামলার প্রতিবাদে রাঙামাটির তিন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ
সিএইচটিনিউজ.কম
রাঙামাটি: রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলার বগাছড়িতে পাহাড়িদের বসতবাড়ি, দোকান ও বৌদ্ধ মন্দিরে সেটলার বাঙালিদের হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এবং হামলাকারীদের গ্রেফতারসহ ৫ দফা দাবিতে নানিয়াচর ভূমি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে আজ বৃহস্পতিবার ১৮ ডিসেম্বর রাঙামাটির কুদুকছড়ি, ঘিলাছড়ি ও বেতছড়ি বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিক্ষোভ সমাবেশে সেটলার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের সদস্যরাসহ হাজার হাজার নারী পুরুষ অংশ গ্রহণ করেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কুদুকছড়িতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নানিয়াচর ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও ঘিলাছড়ি বাজার চৌধুরী নিহার বিন্দু চাকমার সভাপতিত্বে ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি বাবলু চাকমার সঞ্চালনায় সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কুদুকছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্টু বিকাশ চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রিনা চাকমা।
সমাবেশে কুদুকছড়ির বিভিন্ন এলাকা থেকে দেড় সহস্রাধিক লোক অংশ গ্রহণ করেন। সমাবেশের আগে একটি বিক্ষোভ মিছিল কুদুকছড়ি বাজার প্রদক্ষিণ করে।
সমাবেশে কুদুকছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান সন্টু বিকাশ চাকমা নানিয়াচর ভূমি রক্ষা কমিটির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, বগাছড়িতে সেটলাররা যেভাবে পাহাড়িদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করে অতি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি নির্মাণ করে দেয়া।
ঘিলাছড়ি বাজার মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে নানিয়াচর ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য ও বুড়িঘাট ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আনন্দ চাকমার সভাপতিত্বে ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার তথ্য প্রচার সম্পাদক নিকন চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা, ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার জ্ঞান চাকমা, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সদস্য শান্তি প্রভা চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অনিল চাকমা।
সমাবেশে সেটলার হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনসহস্রাধিক লোক অংশ গ্রহণ করেন। সমাবেশের আগে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
ঘিলাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা বগাছড়িতে পাহাড়ি গ্রামে সেটলার হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণও অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু প্রকৃত অর্থে দেশের জনগণের মুক্তির জন্য এদেশ স্বাধীন হতো তাহলে বগাছড়িতে পাহাড়িদের বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হতো না এবং পাহাড়ি জনগণকে এত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকতে হতো না।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসন তুলে নেয়া সহ সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলে সম্মানজনক পুনর্বাসনের দাবি করেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলার বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
একই সময় বেতছড়ি বাজারে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাবেক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও ভূমি রক্ষা কমিটির সদস্য শান্তি বিজয় চাকমার সভাপতিত্বে ও ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার শান্তি বিকাশ চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন সাবেক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বিমল কান্তি চাকমা ও সোনারাম কার্বারী পাড়ার বিশিষ্ট মুরুব্বী কামিনী রঞ্জন চাকমা। এছাড়া সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফ’র প্রতিনিধি বিদ্যাময় চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার সহ সভাপতি কুনেন্টু চাকমা ও নান্যাচর থানা শাখার সভাপতি রিপন চাকমা।
এসব সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, সরকার সেনা-সেটলারদের লেলিয়ে দিয়ে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেদিন (১৬ ডিসেম্বর) সেনাবাহিনীর সহায়তা না পেলে সেটলাররা পাহাড়ি গ্রামে হামল ও অর্ধশতাধিক বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের কোন সাহস পেতো না। হামলায় সেটলাররা ছাড়াও কতিপয় সেনা সদস্যও অংশ নিয়েছিল। এ সময় হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ ৩ জনকে সেনা সদস্যরা মারধর করেছে বলে বক্তারা অভিযোগ করেন।
উক্ত হামলায় আনুমানিক ২ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে দাবি করে বক্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়িরাই পাহাড়ে জমির মালিক হবেন বলে ঘোষণা দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত পাহাড়িদের জমি বেদখলের ঘটনা ঘটছে। বগাছড়িতে পাহাড়িদের শত শত একর জমি জোরপূর্বক দখল করে সেটলাররা আনারসসহ বিভিন্ন ফলের বাগান করছে। আর তাদের এই কাজে প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগিতা দিচ্ছে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা। এতেই প্রমাণ হয়, সরকার কার্যত পাহাড়িদেরকে নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতেই পাঁয়তারা চালাচ্ছে।
বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ভূমি বেদখল বন্ধ না হলে এবং পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার ফিরিয়ে দেয়া না হলে এ ধরনের হামলা বার বার ঘটতে থাকবে। তারা অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার, ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান, লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার, বগাছড়িতে ভূমি বেদখল বন্ধ করা ও সেখান থেকে বহিরাগত সেটলারদের প্রত্যাহারের দাবি জানান।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের সড়ক অবরোধ ও হামলাকারীদের যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বয়কটের আন্দোলন চলবে বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়িতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের ৩টি গ্রামে ৫০টি বসতবাড়ি ও ৭টি দোকান জ্বালিয়ে দেয়, বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালিয়ে ধর্মীয় গুরুকে মারধর, বিহারের জিনিসপত্র তছনছ এবং বুদ্ধমূর্তি ও টাকা পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়।
—————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।