‘বিঝু’ পালন করবে না বগাছড়ির ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি পরিবারগুলো

0

বিশেষ প্রতিবেদন
সিএইচটিনিউজ.কম
রাঙামাটির নান্যাচর উপজেলার বগাছড়িতে গত বছর ১৬ ডিসেম্বর সেনা-সেটলার হামলায় ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পাহাড়ি পরিবারগুলো এখনো ঘরবাড়ি বিহীন ও কষ্টকর অবস্থায় মানবেতর দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কালবৈশাখী ঝড়ে তাদের কষ্ট বেড়েছে আরো দ্বিগুন।  টাবু টাঙিয়ে ছোট ছোট যেসব খুপড়ি ঘরে তারা বসবাস করছেন সে সব ঘরের অনেক ছাউনিও উড়ে গেছে কাল বৈশাখী ঝড়ে। বর্তমানে তারা বৃষ্টিতে ভিজে খুবই কষ্টকর অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। ঠিকমতো খাওয়া, ঘুমানো তাদের এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় তারা এ বছর ‘বিঝু’ উৎসব পালন করবেন না বলে জানিয়েছেন।

Bogachari01প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে ঘর তৈরি করে দেয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও ১০টি ঘর তৈরি করে দেয়ার পর আর কোন ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়নি। যে ঘরগুলো তৈরি করে দেয়া হয়েছে সেগুলোর মানও খুব নিম্ন মানের। তাছাড়া ওই ১০টি ঘর থেকে ৩টি ঘর দখল করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত অবস্থান করছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট খুপড়ি ঘরগুলোতে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে। অনেকের কাপড়-চোপড়, জিনিসপত্র সব ভিজে গেছে।  ভাত রান্নার চুলা ভিজে যাওয়ায় অনেকে ভাতও রান্না করতে পারছেন না। এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলে তারা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানিয়েছেন।

৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র লোচন চাকমা দুঃখভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের ভিজে ভিজে রাত কাটাতে হচ্ছে। আমার বইপত্র, কাপড়-চোপড় সব ভিজে গেছে। স্কুলেও যেতে পারছি না। এ বছর আমরা বিঝুও করতে পারবো না।’

প্রীতিবালা চাকমা বলেন, ‘আমাদের এখন থাকার জায়গা নেই, ঠিকমত ভাত রান্না করতে পারি না, ঝড়ে সব ভিজে যাচ্ছে। খুব অসহায় অবস্থায় রয়েছি। বৃষ্টি হলে সব ভিজে চুরমার হয়ে যায়। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না। ছেলেরাও স্কুলে যেতে পারে না। টাকা পয়সা নেই, ঘরবাড়ি নেই। এ বছর বিঝু পালন করার আমাদের আর কোন অবস্থা নেই।’

সুরিদাস পাড়ার কার্বারী রাম চাকমা অভিযোগের সুরে বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘর তৈরি করে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও এখনো ঘর তৈরি করা হয়নি। সরকার ঘর তুলে দেবে সে বিশ্বাসও হচ্ছে না। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকতো, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রতি যদি দয়া হতো তাহলে নিশ্চয় ঘর তৈরি করে দিতো। যেখানে এক মাসের মধ্যে ঘর তৈরি করা যেতো, সেখানে ঘটনার তিন মাসের অধিক হলেও ঘর তুলে দেয়ার কোন লক্ষণ আর দেখা যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘এই কাল বৈশাখীর সময়ে বড়ই কষ্ট করে বসবাস করতে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের । ঘরের ভিতর পানি পড়ছে। বসে থাকারও কোন অবস্থা নেই। কাপড়-চোপড় রাখার জায়গা নেই। সব ভিজে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে মানুষ কিভাবে বাঁচবে?’

সরকার চক্রান্ত করেই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় সেটলার বাঙালিদের দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়ে দিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।Bogachari02

‘বিঝু’ পালন করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিঝু পালন করার মতো আর কোন অবস্থা নেই। এভাবে ঘরবাড়ি বিহীন অবস্থায় কিভাবে বিঝু উৎসব করবো? এ দূরাবস্থার মধ্যে বিঝু উৎসব করা সম্ভব নয়। এ বছর আমরা বিঝু উৎসব পালন করবো না। যেখানে বসার জায়গা নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই, সেখানে ইচ্ছে থাকলেও বিঝু উৎসব পালন করা সম্ভব হবে না।’

আর্মিরা অবস্থান করাতে নিরাপত্তা মনে করেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নিরাপত্তা মনে করি না। বাঙালিদের পাহারা দিতেই তারা এখানে অবস্থান করছে বলে আমরা মনে করি।

বুড়িঘাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেম্বার ও ক্ষতিগ্রস্ত কাজলী ত্রিপুরা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। গতবছর ১৬ ডিসেম্বর হামলার পর থেকে লোকজন খুব কষ্টকর অবস্থায় দিনযাপন করছে। যা বলার মতো নয়। ঝড়ের কবলে পড়ে টাবু দিয়ে তৈরি ঘরগুলো ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছে’’

তিনি জানান, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘর তৈরি করে দেয়ার আশ্বাস দেয়া হলেও এ পর্যন্ত মাত্র ১০টি ঘর কোন রকম নড়েবড়ে করে তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রশাসন থেকে আর কোন সহযোগিতা দেয়া হয়নি। কোন খোঁজ খবরও নেয়া হয়নি। কোন ত্রাণও দেওয়া হয়নি।’

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘পরিবার-পরিজন ও এলাকাবাসী মিলে ‘বিঝু’র আনন্দ উৎসব করবো এমন চিন্তা এখন আমাদের মন থেকে মুছে গেছে। অনেকের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই, রান্না করার জায়গা নেই, এ অবস্থায় বিঝু উৎসব করার কোন মন-মানসিকতা নেই। এ বছর আমরা বিঝু পালন করবো না।’

Bogachari03৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও ক্ষতিগ্রস্ত আনন্দ চাকমা অভিযোগ করে বলেন, ‘ঘটনার তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ পর্যন্ত মাত্র ১০টি ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে, এরপর থেকে কোন খোঁজ খবর নেই। সরকার ঘর তৈরি দেবে বলেও আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না। এই বৃষ্টির দিনে খুব কষ্টকর অবস্থায় আমাদের দিনযাপন করতে হচ্ছে। সরকারীভাবে আমাদেরকে কোন ত্রাণ দেয়া হয়নি। যে ১০টি ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে সেখান থেকে ৩টি ঘরে এখন আর্মিরা অবস্থান করছে।’

তিনি বলেন, ‘বিঝু পালন করার মতো আমাদের কোন পরিবেশ নেই, মন মানসিকতাও নেই। ঘরদোর নেই অবস্থায় কিভাবে বিঝু পালন করবো। বিঝু পালন করতে হলে মেহমান পরিবেশন করতে হয়। যদি ঘর থাকতো তাহলে বিঝু করতে পারতাম। কিন্তু এখনতো আমাদের ঘরবাড়ি নেই, বসার পর্যন্ত জায়গা নেই। টাবু টাঙিয়ে যেসব খুপড়ি ঘর তৈরি করা হয়েছে সেগুলোর চালাও কাল বৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া টিনগুলো ঢেকে কোন রকমে বেঁচে রয়েছি। এতেও পানি গড়িয়ে পড়ে চাল, কাপড়-চোপড় সব ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন খুবই অসহায়। এ অবস্থায় বিঝু উৎসব করার কোন মন-মানসিকতা আমাদের নেই।’

চিক্কপুদি চাকমা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেন, ‘বর্তমানে খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছি। টাবু টাঙিয়ে কোন রকমে দিনযাপন করছি। ঝড় দিলে সব ভিজে যায়। রাতভর নির্ঘুমে কাটাতে হয়। ভাত ঠিকমতো রান্না করতে পারি না। ঘরবাড়ি তুলে দেয়ার এখনো কোন খবর নেই। এভাবে কিভাবে বেঁচে থাকবো? এ অবস্থায় কিভাবে বিঝু উৎসব করবো?’

উল্লেখ্য, গত বছর ১৬ ডিসেম্বর সেনা-সেটলাররা যৌথভাবে নান্যাচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের সুরিদাস পাড়া, বগাছড়ি ও নবীন তালুকদার পাড়ায় হামলা, অগ্নিসংযোগ করে ৫০টি বাড়ি, ৭টি দোকান ও ১টি ক্লাব পুড়ে ছাই করে দেয়। এছাড়া করুণা বনবিহার নামে একটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মারধর করে।
————————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More