বিতর্কিত বিয়ের খরচ নিয়ে সন্তু গ্রুপের মধ্যে বিভেদ

0

সিএইচটিনিউজ.কম
রাঙ্গামাটি: জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের প্রধান অস্ত্র সংগ্রাহকের বিয়ের খরচ নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক ও বিভেদ দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

গত শুক্রবার ২৬ জুন রাঙামাটিতে সন্তু গ্রুপের অস্ত্র সংগ্রাহক উদয়ন চাকমা ওরফে জিত চাকমার সাথে গলাছড়ি গ্রামের রেশমী চাকমার বিয়ে হয়।

JSSরাঙামাটি সেনা জোন ও আঞ্চলিক পরিষদ কার্যলয়ের পাশে পাবলিক হেল্থ এলাকায় সন্তু লারমার ঘনিষ্ট সহযোগী কিশোর চাকমা ওরপফ ছেত্রী বাবুর (ইলা বাপ) বাড়ীতে তাদের বিয়ের মূল অনুষ্ঠান চুঙুলং সম্পন্ন হয়। আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য ভোজের আয়োজন করা হয় রানী দয়াময়ী স্কুলের পাশে ‘মন্ত্রী ক্লাবে”।

তার বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় বিয়ের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে বৃহষ্পতিবার সন্ধ্যায়।

এই বিয়ে অনুষ্ঠানের খরচের জন্য সন্তু লারমা ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। জিত চাকমা সন্তু গ্রুপের ফিল্ড কমান্ডার লক্ষ্মী প্রসাদ চাকমা ওরফে দেবাশীষ বাবু ওরফে রাজার কাছ থেকেও তার বিয়ের জন্য একই পরিমান টাকা দাবী করেন। দেবাশীষ বাবু প্রথমে তা দিতে সম্মত হন। কিন্তু করুণালংকার ভিক্ষু এতে বাধ সাধেন। করুণালংকারের কথা শুনে তিনি জিত চাকমাকে বিয়ের খরচের জন্য ৭০ হাজারের পরিবর্তে দেন মাত্র ৩০ হাজার টাকা। জিত চাকমা দলের গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেবাশীষ বাবু তার বন্ধু করুণালংকার ভিক্ষুর কথা ফেলতে পারেননি।

জিত চাকমার বিরুদ্ধে করুণলংকার ভিক্ষুর দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ পুষে আসছেন। কারণ এক সময় সন্তু গ্রুপের ভারতে কার্যক্রম পরিচালনা ও অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে করুণালংকার ভিক্ষু প্রধান ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে জিত চাকমা মিজোরামে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। অস্ত্র চোরাকারবারী ও বিভিন্ন বিদেশী বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে করুণালংকারের চাইতে তার বেশী যোগাযোগ রয়েছে। সন্তু গ্রুপের একটি সূত্র মতে, মিজোরামের দারোগা ও সুপারিনটেনডেন্ট লেভেলের সব পুলিশ অফিসার এখন জিত চাকমার পকেটে। তিনি বাংলাদেশ থেকে মিজোরামে গিয়ে বসবাস করা পাংকোদেরও অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছেন। পাংকোরা মোটর সাইকেলের ভেতরে করে গুলি বহন করে দেয়। অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনের কাজে জড়িত এই পাংকোদের নাম জানা গেছে, তবে বিশেষ কারণে তা এখানে প্রকাশ করা হলো না।

সন্তু গ্রুপ মিজোরামের বেশ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তাকে প্রতি মাসে ঘুষ দেয়ার পাশাপাশি মোটর সাইকেলও উপহার দিয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে।

জিত চাকমার এই সাফল্য সন্তু গ্রুপের মধ্যে করুণালংকার ভিক্ষুর প্রভাব কমিয়ে দিয়েছে, যদিও তিনি এক সময় ভারতে সন্তু গ্রুপের অস্ত্র সংগ্রহের পুরো ব্যাপারটি একাই দেখাশোনা করতেন।

করুণালংকার ভিক্ষু থাকেন দিল্লীতে। অপরদিকে জিত চাকমা অবস্থান করেন মিজোরামের আইজলে। তিনি ভারতের নাগাল্যান্ড ও বার্মা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের বিষয়টি দেখাশোনা করেন। অন্যদিকে করুণালংকার ভিক্ষুর কাজ এখন কেবল মাত্র আসাম থেকে অস্ত্র সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে। জানা গেছে তিনি বর্তমানে আসামের বোডো বিদ্রোহীদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন।

করুণালংকার ভিক্ষু রেবতী ভিক্ষু নামে অন্য একজনকে তার কাজে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ দিয়েছেন। রেবতী ভিক্ষু হলেন বাংলাদেশী, তবে আসামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তারা দু’জনে মিলে চোরাইবাড়ি বর্ডার পোষ্ট দিয়ে আসাম থেকে ত্রিপুরায় অস্ত্র নিয়ে গেলেও বর্তমানে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সর্ব শেষ ৪১ টি গ্রেনেড তারা যখন এই পয়েন্ট দিয়া নিয়ে আসেন, তখন করুণালংকার ভিক্ষুকে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের মোটা অংকের ঘুষ দিতে হয়েছিল। ভারতীয় কর্মকর্তারা এর বিনিময়ে এই গ্রেনেডগুলো ত্রিপুরার গন্ডাছড়া পর্যন্ত স্কট দিয়ে পৌঁছে দেন।

সন্তু গ্রুপের অস্ত্র সংগ্রহের কাজে আরো একজন জড়িত আছেন। তার নাম হলো স্বদেশ বাবু। তবে তিনি স্থানীয় ভাষা জানেন না বলে তাকে কেবল অর্থ বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জিত চাকমা যত টাকা দাবী করেন তা তাকে দিতে হয়। এছাড়া তার কোন কাজ নেই। করুণালংকার ভিক্ষু জিত চাকমা অস্ত্র কেনার জন্য যে টাকা দাবী করেন সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন বেশ কয়েকবার। তিনি তার একান্ত আপন সহযোদ্ধাদের বলেছেন, “জিত চাকমা একজন মাদকসেবী, হিরোইন খোর। মিজোরাম হলো মাদকের জন্য বিশ্ববিখ্যাত, আর জিত চাকমা মাদক কেনার জন্য সব টাকা নষ্ট করছে। সন্তু লারমা এভাবে মাদকাসক্তদের প্রাধান্য দিলে কিভাবে কাজ চলবে?”

অস্ত্র কেনার জন্য সন্তু লারমার প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয় এবং এই টাকা বাংলাদেশী মুদ্রায় পরিশোধ করা যায় না। সন্তু লারমা কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে আড়াই কোটি টাকা মূল্যের ডলার কেনেন অস্ত্র ও গোলাবারুদের মূল্য পরিশোধের জন্য।

মিজোরাম ও ত্রিপুরায় এত বিপুল পরিমান টাকা বদল করা যায় না বলে তারা ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। জিত চাকমা তার বিয়ের পর মিজোরামে ফিরে যাওয়ার সময় এই ডলারগুলো সন্তু লারমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন বলে প্রকাশ।

মিজোরামের এক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে জিত চাকমা হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র চোরাকারবারী। আর পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র চোরাকারবারীদের মধ্যে তার অবস্থান শীর্ষ দশের মধ্যে থাকবে।

তিনি আরো বলেন, তার সরবরাহকৃত অস্ত্রগুলোর কিছু অংশ সন্তু গ্রুপের হাত হয়ে বাংলাদেশের ইসলামী জঙ্গী গ্রুপগুলোর হাতেও হয়তো ইতিমধ্যে পড়েছে, নতুবা ভবিষ্যতে পড়তে পারে। তাই ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে অবশ্যই ভাবতে হবে।

জিত চাকমার আসল নাম হলো উদয়ন চাকমা। তার পিতার নাম বিপর্সী চাকমা, বাড়ি খাগড়াছড়ি শহরের অনন্ত মাষ্টার পাড়ায় (নারানখাইয়া)। তিনি ছিলেন মাদকাসক্ত। সন্তু লারমা খাগড়াছড়িতে থাকার সময় নিজ দলে ভেড়ানোর জন্য ছাত্র-যুবকদের কাছে নিয়মিত মাদকদ্রব্য সরবরাহ করতেন। খাগড়াছড়িতে সে সময় যে সব ছাত্র-যুবক সন্তু লারমার সরবরাহ করা নেশায় নষ্ট হয়ে যান তার মধ্যে উদয়ন চাকমা হলেন একজন। পড়াশোনা ইস্তফা দিয়ে তিনি তার বাবার সাথে ঝগড়া করে জেএসএস-এ যোগ দেন। ২০০৬ সালের প্রথমদিকে জেএসএস দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি সন্তু গ্রুপের পক্ষে চলে যান। পরে তাকে অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে মিজোরামের আইজলে পোষ্টিং দেয়া হয়। তিনি মূলত সজল বাবু ওরপে স্বদেশ বাবুর অধীনে কাজ করে থাকেন। সজল বাবুর আস্তানাও মিজোরামের রাজধানী আইজলে। তিনি মূলত আর্থিক বিষয়টি দেখাশোনা করেন। তিনি ইংরেজী, হিন্দি কিংবা মিজো ভাষা কোনটাই জানেন না।

জিত চাকমা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য প্রধানত ভারত-বিরোধী বিভিন্ন বিদ্রোহী সংগঠন ও বার্মার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন।

কিছু দিন আগে তিনি সন্তু লারমার নির্দেশে রাঙামাটি আসেন।
——————–

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More