বৈসাবি উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে চারদিন ব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা: ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান

0

সিএইচটি নিউজ বাংলা, ৮ এপ্রিল ২০১৩, সোমবার
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উ
সব বৈসাবিকে(বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু) সামনে রেখে “ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সংগ্রামী চেতনা প্রজ্জ্বলিত করুন” এই শ্লোগানে খাগড়াছড়িতে সর্বজনীন বৈসাবি উদ্‌যাপন কমিটির উদ্যোগে আগামী ৯, ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল চার দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।

আজ ৮ এপ্রিল সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভরস্থ ঠিকাদার সমিতি ভবনের হলরুমে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বৈসাবি উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দ এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এ সময় মহান বৈসাবি উসবকে সামনে রেখে একে অপরের প্রতি ক্ষমা ও মৈত্রীভাব প্রদর্শন পূর্বক পারস্পরিক হানাহানি বন্ধ করার জন্য পার্বত্য চট্টগামের আঞ্চলিক রাজনেতিক দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বৈসাবি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ৯, ১০ ও ১১ এপ্রিল তিনদিন ব্যাপী স্বনির্ভর মাঠে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, বলিখেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ১২ এপ্রিল ভোর ৫টায় চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসানো ও সকাল ৮টায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ক্ষেত্র মোহন রোয়াজা প্রেস ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বৈসাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসমূহের প্রধান সামাজিক উসব। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বিদেশে যেখানেই পাহাড়িরা বসবাস করেন সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ও ঘরে ঘরে এই উসব পালন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সমতলের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত কোন কোন সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জনগণও ভিন্ন নামে এই উসব পালন করে থাকেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই উসবের জন্য সরকারী ছুটি না থাকায় আমরা আমাদের প্রিয় ও প্রধান উসবটি ঠিকমত পালন করতে পারি না। উসবের দিন আমাদের অফিস করতে হয়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাক্টরীতে চাকুরীরত পাহাড়িদেরকে সারাদিন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে রাত অবধি কাজ করতে হয়, ছাত্রদের স্কুল বা কলেজে যেতে হয় ও পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। অথচ মুসলিম ও হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক উসব যথাক্রমে ঈদ ও দূর্গা পূজা উদযাপনের জন্য সরকারীভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা সরকারের এই আচরণকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করি। আমরা আশা করি, সরকার এই বিষয়টির প্রতি সুদৃষ্টি দেবেন।
বৈসাবি ঘনিয়ে এলে উকণ্ঠায় থাকতে হয় উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, একে তো উসব পালনের জন্য ছুটি নেই, তার উপর উসবের প্রাক্কালে প্রায়শঃ কোন না কোন এলাকায় পাহাড়িদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। এর ফলে পুরো উসবই পণ্ড হয়ে যায়, আনন্দ-উসব শোকে পরিণত হয়। নিকট অতীতে পাহাড়িদের জাতীয় জীবনে এভাবে বহু বৈসাবি উসব হারিয়ে গেছে। ১৯৯২ সালে বৈসাবির মাত্র কয়েক দিন আগে ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হলে তার প্রতিবাদে পাহাড়িরা উসবের জন্য ঘরে ঘরে রান্না করা ‘পাজন’ নদীতে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়। চুক্তির পরও বেশ কয়েকবার পাহাড়িরা সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে বৈসাবি উসব বর্জন করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন ২০০৬ সালে মাইসছড়িতে সেটলার হামলার পর বৈসাবির আনন্দোসব প্রতিবাদের মিছিলে রূপান্ত্মরিত হয়েছিল। মোট কথা, বৈসাবি উসব যতই ঘনিয়ে আসে ততই আমাদেরকে উদ্বেগ ও উকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয় কোথাও কোন অঘটন ঘটলো কিনা।
তিনি বলেন, আনন্দ উসবের জন্য প্রয়োজন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। অশান্তি ও অরাজকতার মধ্যে উসব করা যায় না, আনন্দ করা যায় না। তাই আমরা মনে করি, যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না ততদিন পাহাড়িরা নির্বিঘ্নে, নিরাপদে ও নির্ভয়ে বৈসাবি উসব পালন করতে পারবে না। সরকার একদিকে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা বলছে, অন্যদিকে এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বৈসাবি উসব পালনের জন্য ছুটিসহ উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছে না – এটা অত্যন্ত স্ববিরোধী।
প্রেস ব্রিফিং থেকে বৈসাবি উদ্‌যাপন কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে:
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সর্ববৃহ সামাজিক উসব বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু বা বৈসাবি পালনের সুবিধার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণভাবে এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরকারী, বে-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পাহাড়ি চাকুরীজীবীদের জন্য ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল ৩ (তিন) দিনের ছুটি ঘোষণা করতে হবে। (১৪ এপ্রিল নববর্ষের জন্য সরকারী ছুটি থাকলেও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে নেই।)
২. বৈসাবি উসবের আগে যাতে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা বা সহিংস ঘটনা না ঘটে তার জন্য উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোর উপর কড়া নজরদারী রেখে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. উসবের আগে ও উসবের সময় পাহাড়িদের গ্রামে সেনা বা নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা, টহল, ঘেরাও ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে।
৪. সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল পূর্বক পাহাড়ি জনগণের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগামের আঞ্চলিক রাজনেতিক দল ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর উভয় পক্ষের প্রতি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মহান বৈসাবির চেতনা হলো ঐক্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। এদিন একে অপরের ভুলক্রুটি উদার চিত্তে ক্ষমা করে দেয়া হয়। তাই মহান বৈসাবি উসবকে সামনে রেখে একে অপরের প্রতি ক্ষমা ও মৈত্রীভাব প্রদর্শন পূর্বক পারস্পরিক হানাহানি বন্ধ করুন।

এ সময় নেতৃবৃন্দ ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এম.এন লারমা গ্রুপ) আলোচনার মাধ্যমে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধে  প্রস্তুত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রাখার নীতি পরিত্যাগ করে আলোচনার টেবিলে আসার জন্য সন্তু লারমা গ্রুপের প্রতি বিশেষ আহ্বান জানান।
প্রেস ব্রিফিং থেকে পার্বত্য জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে বৈসাবি উসব পালন করতে পারেন তার জন্য আগামী ৯ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে হরতাল ও অবরোধের আওতামুক্ত রাখার জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন বৈসাবি উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব দীপায়ন চাকমা, বিশিষ্ট মরুব্বী কিরণ মারমা, কংচাইরী মাষ্টার, নারী নেত্রী শেফালিকা ত্রিপুরা ও নমিতা চাকমা প্রমুখ।
———–

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More