বৌদ্ধ সাধক বনভান্তের জন্মোৎসব কাল
রাঙামাটি প্রতিনিধি
সিএইচটিনিউজ.কম
বনভান্তে নামে সর্বাধিক পরিচিত মহান বৌদ্ধ সাধক অর্হৎ আর্যশ্রাবক সাধনানন্দ মহাস্থবিরের জন্মোৎসব আগামীকাল। এ উপলক্ষে রাঙামাটি রাজবন বিহারে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য্যের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হবে।
রাজবন বিহার সূত্রে জানা গেছে, শ্রদ্ধেয় বনভান্তের জন্মোৎসবের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বনভান্তের প্রতি পুষ্পমাল্য অর্পণ, সংঘ দান, অষ্ট পরিষ্কার দান (ভিক্ষুদের ৮টি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু) ও বুদ্ধমূর্তি দান। অনুষ্ঠান সকাল ৯টায় রাজবন বিহার মাঠে শুরু হয়ে ১১টায় শেষ হবে।
অনুষ্ঠানে শ্রীমৎ সুমনালঙ্কার মহাস্থবির, ভৃগু মহাস্থবির, শাসনরতি মহাস্থবির ও জ্ঞানপ্রিয় মহাস্থবিরসহ শ্রদ্ধেয় বনভান্তের শীর্ষ শিষ্যমণ্ডলী উপস্থিত থাকবেন ও ধর্মীয় দেশনা দেবেন।
এছাড়া দীঘিনালার বনবিহারেও শ্রদ্ধেয় বনভান্তের জন্মোৎসব পালন করা হবে বলে জানা গেছে।
মহান সাধক বনভান্তে ১৯২০ সালের ৮ জানুয়ারী রাঙামাটি শহরের ৬ মাইল দক্ষিণে মগবান মৌজার মোরঘোনা নামক গ্রামে এক সাধারণ চাকমা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রতিবেশীর বেদনাদায়ক মৃত্যু এ সময় তাকে গভীরভাবে আলোড়িত ও ভাবিত করে তোলে এবং তার মনে বৈরাগ্যভাবের জন্ম দেয়।
পরে ১৯৪৯ সালে ২৯ বছর বয়সে তিনি চট্টগ্রামের নন্দন কানন বৌদ্ধ বিহারে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। সেখানে শ্রীমৎ দীপংকর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবিরের তত্ত্বাবধানে বুদ্ধের শিক্ষ গ্রহণের পর তিনি ধ্যান-সাধনার জন্য রাঙামাটির জীবতলী ইউনিয়নের ধনপাদায় গভীর অরণ্যে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি ঝড়বৃষ্টি রোদ শীত উপেক্ষা করে শ্বাপদসংকুল পরিবেশে মশা মাছির উৎপাত সহ্য করে ভুক্ত অভুক্ত থেকে ১১ বছর ধরে কঠোর তপস্যা চালিয়ে যান এবং শীঘ্রই লোকসমাজে বনশ্রামণ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
এরপর কাপ্তাই বাঁধের কারণে রাঙামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলে নিশিমনি চাকমা নামে এক উপাসক তাকে আমন্ত্রণ করে দীঘিনালার বোয়ালখালিতে নিয়ে যান। সেখানেও তিনি লোকবসতি থেকে দূরে বনের মধ্যে বাস করতে থাকেন। এ সময়ই বনভান্তে নামে তার পরিচিতি ও খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬১ সালে বনভান্তে উপসম্পদা লাভ (পূর্ণ ভিক্ষু মর্যাদা) করেন। ১৯৭০ সালের দিকে তিনি প্রথমে কাচালঙের দুরছড়ি ও পরে লংগুদুর তিনটিলায় অবস্থান করেন। ১৯৭৪ সালে চাকমা রাজা তাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাঙামাটিতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। ২০১২ সালের ৩০ জানুয়ারী বনভান্তে ঢাকায় মহাপরিনির্বাণ (দেহত্যাগ) লাভ করেন।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বুদ্ধের নীতি ও শিক্ষা অনুসারে কঠোর তপস্যার মাধ্যমে অর্হৎ অর্থাৎ সর্বদুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি ঋদ্ধি শক্তির (ধ্যানবলে প্রাপ্ত বিশেষ জ্ঞান) অধিকারী বলে মনে করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণে মহান সাধক বনভান্তের অবদান অপরিসীম। তিনি সারা জীবন ক্ষমা, করুণা, মৈত্রী ও সর্বজীবে দয়ার কথা প্রচার করে গেছেন। ত্যাগ ও সাধনার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা কেবল নির্বাণ লাভেচ্ছুদের নয়, সাধারণ মানুষেরও অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তিনিই প্রথম মহামতি বুদ্ধের সময়ে বিশাখা কর্তৃক প্রবর্তিত নিয়মানুযায়ী রাজবন বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব চালু করেন। এই নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সূতা বানিয়ে তা দিয়ে কাপড় বুনে ভিক্ষুদের ব্যবহারের জন্য চীবর তৈরি করা হয়। প্রতি বছরে এই উৎসবে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটে।
তিনি কেবল বৌদ্ধদের কাছে পূজনীয় নন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি পরম শ্রদ্ধার পাত্র। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা প্রতি বছর কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে বাণী দিয়ে থাকেন। মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূতসহ দেশ বিদেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তার দর্শন লাভে কৃতার্থ হতেন। উপাসক উপাসিকারা পিনপতন নীরবতায় ও গভীর আগ্রহ সহকারে তার ধর্মীয় দেশনা শুনতেন।
পরিনির্বাণ লাভের পর রাঙামাটির রাজবন বিহারে তার পবিত্র শবদেহ মমি করে শায়িত রাখা হয়েছে। তাকে দেখতে বিহারে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। ফলে রাজবন বিহার এখন এক তীর্থক্ষেত্র পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো শ্রদ্ধেয় বনভান্তের মমিকৃত শবদেহ দর্শন ও রাজবন বিহারের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা।
সদ্ধর্মে আলোকিত মহান পুরুষ বনভান্তে জীবিত থাকতেই এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। তার ত্যাগ ও অর্জনে উৎসাহিত হয়ে অনেকে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তার কয়েকশত শিষ্য রয়েছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে বিদেশে তার শিষ্যদের প্রতিষ্ঠিত বহু শাখা বনবিহার রয়েছে।
বলা হয় দুনিয়ায় বুদ্ধগণের আবির্ভাব দুর্লভ। বনভান্তের মতো অর্হৎ ভিক্ষুর আবির্ভাবও সব সময় ঘটে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে তার মতো মহাপুরুষের জন্মের জন্য হয়তো আমাদের আরো বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। #