ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ ও সুবিচারের দাবিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে শহীদ ইউপিডিএফ সদস্য, সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীদের স্বজন ও পরিবারবর্গের মানববন্ধন
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি প্রতিনিধি
সিএইচটিনিউজ.কম
সরকারের কাছে সুবিচার ও সন্তু লারমার কাছে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবিতে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে শহীদ ইউপিডিএফ সদস্য, সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীদের স্বজন ও পরিবারবর্গ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। আজ ৩০ নভেম্বর বুধবার সকাল ১১টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভরে এবং রাঙামাটি জেলা সদরের কুদুকছড়িতে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
শেখ হাসিনার কাছে ন্যায় বিচার ও সন্তু লারমার কাছে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের দাবি জানিয়ে শহীদ পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইউপিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ অনিমেষ চাকমার সহধর্মিনী মিন্টি চাকমা। এতে শহীদ রূপক চাকমার মা রঙ্গিলা চাকমা, শহীদ রুইখই মারমা সহধর্মিনী রিতা চাকমা, শহীদ সাইদিঅং মারমার পিতা অংথোয়াই মারমাসহ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, শহীদ হরেন্দ্র দেওয়ানের স্ত্রী সূষমা চাকমা, শহীদ হরক্যা দেওয়ানের পিতা রেবতী চাকমা, শহীদ আনন্দময় চাকমার পিতা সত্য কুমার চাকমা, শহীদ বিরলা কার্বারীর ছেলে রূপন জ্যোতি দেওয়ান, শহীদ মৃণাল কান্তি চাকমার বোন মেরিনা চাকমা, শহীদ যুদ্ধমনি ত্রিপুরার পিতা গজেন্দ্র ত্রিপুরাসহ ১১৪ জন শহীদ পরিবারবর্গের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন অংশগ্রহণ করেন। এ সময় শহীদ অনিমেষ চাকমার ছেলে প্রাজ্ঞ প্রাচুর্য চাকমা (ইধোত)”সন্তু লারমা, আমার বাবাকে কেন খুন করেছ?” লেখা প্লেকার্ড সম্বলিত তার বাবার ছবি বুকে ঝুলিয়ে মানববন্ধনে অংশ নেয়। এছাড়া সন্তু গ্রুপ কর্তৃক নিহত এমএন লারমা গ্রুপের সদস্য চিজিমনি চাকমার স্ত্রী রত্না চাকমা ও সোহেল চাকমার স্ত্রী রুনা চাকমাও মানববন্ধনে অংশ নেন।
অন্যদিকে রাঙামাটির কুদুকছড়িতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শহীদ বীর চাকমার মেয়ে লুম্বিনী চাকমা। এতে শহীদ কিরণ ও বিকু চাকমার পিতা জুরন্ত কুমার চাকমা, শহীদ প্রীতি কুমার চাকমার মাতা সুরন্ত মালা চাকমা, শহীদ চাইথুই প্রু মারমার স্ত্রী নিহাইপ্রু মারমা, শহীদ সুভাষ চাকমার পিতা অজিত চাকমা, শহীদ সুরেশ মোহন কার্বারীর স্ত্রী দিনমুখী চাকমা, শহীদ মানেক চন্দ্র চাকমার স্ত্রী চম্পা চাকমা, শহীদ বীর চাকমার স্ত্রী বিউটি চাকমা, শহীদ সঞ্চয় বিকাশ চাকমার স্ত্রী সুমিতা চাকমা সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শহীদ পরিবারবর্গের ৯৫ জন পরিবারের সদস্য ও স্বজন অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে ‘সন্তু লারমা, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ কর; সন্তু লারমা, ভাইয়ের বুকে গুলি চালানো বন্ধ কর; যারা সংঘাত চায়, তারা জাতীয় শত্রু; ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি নয়,ঐক্য চাই; ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি নয়, আন্দোলন চাই; নিহত ইউপিডিএফ নেতা-কর্মী-সমর্থক পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দাও; শহীদ ইউপিডিএফ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের খুনীদের শাস্তি চাই; বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা কর; ইউপিডিএফের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নাও; যারা ঐক্য চায় না, তারা সরকারের দালাল,বিভেদ সংঘাত নয়, ঐক্য চাই;বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে তোল‘— ইত্যাদি শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বুকে ঝুলিয়ে শহীদ ইউপিডিএফ সদস্য, সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীদের স্বজন ও পরিবারবর্গ মানববন্ধনে অংশ নেন।
মানববন্ধনে সরকার ও জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের সভাপতি সন্তু লারমার উদ্দেশ্যে শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তিকে বর্তমান ইউপিডিএফ নেতৃবৃন্দ সে সময় চুক্তির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সে সময় চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলো অর্থাৎ সরকার ও জেএসএস চুক্তির কোন দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা ছিল তা কিছুতেই মানতে চাইত না। সরকারের আন্তরিকতা ও সদইচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুললে সন্তু লারমা রীতিমত ক্ষেপে যেতেন, আওয়ামী লীগকেই পাহাড়ি জনগণের একমাত্র সহানুভূতিশীল দল বলে তিনি সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। চুক্তির দুর্বলতা ফাঁস হয়ে পড়ায় সরকার-সেনাবাহিনীর চক্রও মহা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। যেহেতু চুক্তির মধ্যে বড় ধরনের গলদ রয়েছে, ছেলে ভুলানোর নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এটি ছিল বাস্তবত শুভঙ্করের ফাঁকি। চুক্তির ফাঁক ফোকর বর্তমানে সবার নিকট উন্মোচিত হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, চুক্তির সমালোচনা করে ইউপিডিএফের নেতাকর্মীরা কোন ভুল করেনি। এ দেশে প্রত্যেক নাগরিকের নিজের মতামত প্রকাশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। সংবিধানে সেই অধিকার দেয়া হয়েছে এবং রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর ইউপিডিএফের সদস্যরা সেই মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে কোন অন্যায় করেননি। অথচ সেই অধিকার প্রয়োগ করার কারণেই, কেবল চুক্তির সমালোচনা করার কারণেই আমাদের ছেলে, স্বামী ও বাবাদের মেরে ফেলা হয়েছে। গত ১৪ বছরে ইউপিডিএফের ২২৮ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক খুন হয়েছেন। অথচ এসব খুনের একটিরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি।
তারা বলেন, আমাদের ছেলে, স্বামী ও বাবারা যারা শহীদ হয়েছেন অর্থাৎ যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তারা একটি সুমহান আদর্শ লালন করতেন, এদেশের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় তারা সংগ্রাম করে গেছেন। আর এ কারণেই দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এখানকার পদলেহী দোসররা তাদের খুন করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান আত্মধ্বংসী ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের জন্য সন্তু লারমা ও সরকারকে দায়ি করে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, এ সংঘাতের মূল হোতা হচ্ছে সন্তু লারমা ও সরকার। পাহাড়ি জনগণকে ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর অন্যায় শাসন-শোষণ চালানোর হীন উদ্দেশ্যেই সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ সংঘাত বাধিয়ে দিয়েছে। পাহাড়িদের ভাগ করে একটি অংশকে সরকার কোলে তুলে নিয়ে অর্থ-মতা-সুযোগ-সুবিধার উচ্ছিষ্ট ভাগ দিয়েছে, এটি হচ্ছে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন চক্র। এদের দিয়ে গোটা জনগণের ওপর খবরদারি কায়েম করতে চায় সরকার। ইউপিডিএফ ও জেএসএস উভয় পরে যত জন সংঘাতে নিহত হয়েছেন তার প্রত্যেকের মৃত্যুর জন্য সন্তু লারমা-সরকার উভয়েই দায়ী।
লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত সেনাবাহিনীর মধ্যকার সবচে‘ দুর্নীতিগ্রস্ত অযোগ্য ও কায়েমী স্বার্থবাদী একটি অংশ গোপন সামরিক বাজেট পকেটস্থ করার ধান্দায় লিপ্ত। মূলত এ অংশটিই নিজেদের রুজি রোজগারের জন্য পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। বাঘাইছড়িতে সন্তু গ্রুপের হাতে অস্ত্র ও গোলা বারুদ পৌঁছে দেয়ার সময় হাতে নাতে এক ডিজিএফআইয়ের মেজরের ধরা পড়া, লক্ষ্মীছড়িতে থানা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে সেনা জোনের পাশে বোরকাদের আস্তানায় র্যাবের হামলা, খাগড়াছড়ি ও পানছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের নামে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করা — এই কয়টি ঘটনার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট হয়েছে কারা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত জিইয়ে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি বজায় রাখতে চায়।
লিখিত বক্তব্যে তারা সন্তু লারমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নিজ প্রাণের প্রতি সব প্রাণীরই মায়া থাকবে, এটাই প্রকৃতির ধর্ম। আপনিও তো মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পান, এটা শান্তিবাহিনীর উর্ধ্বতন ব্যক্তিরা সবাই জানে। শুধু মৃত্যু কেন, গ্রেফতারের কথা উঠলে কাঁপতে থাকেন। বিগত জরুরী অবস্থার সময় গ্রেফতার এড়াতে আপনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ও ঢাকায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে ধর্ণা দিয়েছিলেন বলে আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি। পদাছড়ায় থাকার সময় আপনার ভীতি সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আপনার কাছে আমাদের প্রশ্ন, নিজের প্রাণকে আপনি এত ভালবাসেন, অথচ অন্যজনের প্রাণের প্রতি কেন আপনার সামান্যতম মায়াও নেই? নিজের প্রাণকে প্রাণ মনে করেন, আর অন্য জনের প্রাণকে কি প্রাণ মনে করেন না? জনতার ক্রোধ সাপের ফণার মত ফুঁসে উঠে আপনাকে এ প্রশ্ন করছে! যেখানে আপনার নিজের প্রাণ আপনার কাছে প্রিয়, সেখানে আপনি অন্যের প্রাণ কেড়ে নিতে পারেন না।
মানববন্ধনে সন্তু লারমার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, অবিলম্বে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধ করুন, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত শুরু করার জন্য এবং বহু লোকের প্রাণহানির জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকারকে স্বীকার করুন, বিরুদ্ধ মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং যদি আন্দোলনে সামিল হতে চান, তাহলে ইউপিডিএফের সাথে সমঝোতা করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দিন। তা না হলে চুপ করে থাকুন; নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করবেন না।
মানববন্ধন থেকে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে উস্কানি দেয়া বন্ধ করে সংঘাত বন্ধ করতে সন্তু লারমার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, নিহত ইউপিডিএফ সদস্য ও সমর্থকদের খুনীদের গ্রেফতার ও শাস্তি, নিহত ইউপিডিএফ সদস্য ও সমর্থকদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইউপিডিএফের পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেয়ার দাবি জানানো হয়।