মিঠুন চাকমা হত্যার ৩ বছর : খুনিরা গ্রেফতার হয়নি, ঘুরছে প্রশাসনের নাকের ডগায়!

0
শহীদ মিঠুন চাকমা। ফাইল ছবি

স্টাফ রিপোর্টার ।। আজ ৩ জানুয়ারি ২০২১ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমা হত্যার ৩ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৮ সালের এই দিনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৃষ্ট সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে মিঠুন চাকমাকে গুলি করে খুন করে। কিন্তু তিন বছরেও খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়! সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশের প্রশাসন!

জানা যায়, সেদিন (৩ জানুয়ারি ২০১৮) দুপুর ১২টার দিকে খাগড়াছড়ি জেলা আদালত থেকে একটি মামলায় হাজিরা দেয়ার পর শহরের অপর্ণা চৌধুরী পাড়ার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন মিঠুন চাকমা। বাড়িতে পৌঁছার আগে বাড়ির প্রবেশ গেটে দেখা হয় তার ছোট ভাইয়ের সাথে। সেখানে দু’ভাইয়ে পারিবারিক আলাপ করছিলেন তারা। এ সময় হঠাৎ মোটর সাইকেলযোগে একদল সন্ত্রাসী এসে তাদের ঘিরে ধরে এবং সেখান থেকে মিঠুনকে অস্ত্রের মুখে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়। এরপর দক্ষিণ পানখাইয়া পাড়া এলাকায় নিয়ে গিয়ে রাস্তার মাঝে সন্ত্রাসীরা তাকে মাথায় ও বুকে গুলি করে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিভে যায় একটি উজ্জ্বল প্রদীপ।

মিঠুন চাকমা খুনের সাথে সেনা-প্রশাসনেরও যে যোগসাজশ ছিলে সেটা তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাধাদানের মাধ্যমেই অনেকটা স্পষ্ট হয়েছিল। মিঠুনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দিন সকাল থেকেই সেনাবাহিনী ও পুলিশ যেভাবে খাগড়াছড়ি প্রবেশ পথসহ বিভিন্ন জায়গায় চেকপোষ্ট বসিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা লোকজনকে বাধা প্রদান করে তাতে খুনের ঘটনায় আসল মদদদাতাদের চেহারা ভেসে উঠে। যার কারণে হত্যার তিন বছরেও পুলিশ মিঠুন চাকমার খুনিদের গ্রেফতারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। ফলে খুনিরা রয়েছে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের আশে-পাশে। চালাচ্ছে নানা অপরাধকর্ম।

এই হত্যাকাণ্ডের আগেও মিঠুনকে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে তার নামে মিথ্যাভাবে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে কারাগারে বন্দি করা হয়েছিল। এ মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল আরো ডজনের অধিক মিথ্যা মামলা।

মিঠুন চাকমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ স্বেচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করে জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে প্রত্যক্ষভাবে সামিল হতে ইউপিডিএফে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই সাথে তিনি দেশের প্রগতিশীল সংগঠন ও আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন।

মিঠুন চাকমা ছিলেন ইউপিডিএফ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও দেশের নিপীড়িত মানুষের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী । তার মধ্যে ছিল সমাজ পরিবর্তনের বিশাল তাড়না। তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কথা ভাবতেন না, ভাবতেন বিশ্বের সকল নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কথাও। মৃত্যুর বছরখানিক আগে তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের সংগ্রামের উপর একটি লেখাও লিখেছিলেন। যেটি তিনি পুস্তিকা আকারেও বিলি করেছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ব্লগেও সমান সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ব্লগে নিয়মিত লিখতেন। তার বেশ কিছু লেখা mithunchakma.blogspot.com এই ব্লগসাইটটিতে রয়েছে (যারা তাঁর লেখা পড়তে আগ্রহী তারা ব্লগটি দেখতে পারেন)। এছাড়া তিনি বিডি নিউজ ব্লগ, সামহোয়ারইন ব্লগসহ বিভিন্ন ব্লগে সক্রিয় থেকে নানা বিষয়ে লেখালেখির কাজে যুক্ত ছিলেন।

আজ হয়তো মিঠুন চাকমা বেঁচে নেই, কিন্তু তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের মুক্তিকামী মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। ঘাতকরা তাকে মেরে ফেলতে পারলেও তার চিন্তা-চেতনা, তার সৃষ্টিকে মেরে ফেলতে পারেনি। তার সৃষ্টি ও চিন্তা-চেতনা থেকে নতুন প্রজন্ম যদি কিছুটা হলেও ধারণ করতে পারে তাহলেই তার মৃত্যু সার্থক হবে।

এখানে আরও যে কথাটি বলা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে- মিঠুন চাকমার খুনি-সন্ত্রাসীদের উপদ্রব এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনা-প্রশাসনের আদর-যত্নে এই সন্ত্রাসীরা অবাধে খুন, গুম, অপহরণ, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়সহ জনগণের উপর নানা উপদ্রব চালিয়ে যাচ্ছে। এই খুনিরাই এখন জননিরাপত্তার চরম হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আর খুনিদের মদত, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সেনা-প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অরাজকতা জিইয়ে রাখতে চায়।

তাই, এই খুনি চক্রটির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনগণ ও তরুণ প্রজন্মকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং মিঠুন চাকমাকে হত্যার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

 


সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More