মুখোশ বাহিনী থেকে নব্য মুখোশ বাহিনী : রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের একাল সেকাল

0

।। রাজনৈতিক ভাষ্য ।।
মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার শক্তির মধ্যে ভাঙন ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত সৃষ্টি করে শাসন শোষণ জারী রাখা হলো শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি প্রাচীন কৌশল। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীও বারবার এই একই কৌশল প্রয়োগ করছে। তাই আমরা দেখতে পাই তথাকথিত টাইগার বাহিনী, লায়ন বাহিনী, গপ্রক বাহিনী, মুখোশ বাহিনী – যাদেরকে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনের জন্য। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনে এইসব সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে এবং সেই সাথে জুম্ম জনগণের আন্দোলন দমনের এই সেনা কৌশলও বার বার ব্যর্থ ও পরাস্ত হয়েছে।

উপরোক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধেই সবচেয়ে জোরদার ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। জনগণের মধ্যে মুখোশ বাহিনী নামে পরিচিত হলেও সেনাবাহিনী এর নাম দিয়েছিল ‘পিসিপি, পিজিপির সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি বা পিপিএসপিসি’। নামেই বোঝা যায় এই ‘কমিটির’ গঠনের লক্ষ্য কী ছিল। মেজর মাহবুব নামের জনৈক সেনা কর্মকর্তা এই সংগঠনটির গঠন ও তার কর্মকান্ড পরিচালনায় নেপথ্যে কাজ করেছিলেন। পরে এই মেজর ঢাকার বাড্ডায় ছিনতাই কালে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

কিন্তু খাগড়াছড়িতে ১৯৯৫ সালে কেন এই সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টির কাজে সেনাবাহিনী হাত দিয়েছিল? সেই সময়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে পার্বত্য ছাত্র-যুব সমাজ সেনা নির্যাতন তথা জুম্ম ধ্বংসের সেনা-সরকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন জোরদার করতে সক্ষম হয়েছিল। নারী সমাজ সংগঠিত হয়েছিল হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতৃত্বে। জেসএসএস যখন কোনোভাবেই তাদের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’কে টেনে নিতে পারছিলো না, তখন জুম্ম জনগণের মধ্যে আশা জাগানিয়া হয়ে এসেছিলো পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ি গণ পরিষদ। জনগণের মধ্যে নিরাশার মাঝে আশা সঞ্চার হয়েছিল। এই সংগঠনসমূহের নেতৃত্বে জনগণ ফুঁসে উঠতে শুরু করছিলো। জনগণের এই ফুঁসে ওঠা প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগ্রামকে দমন করতে সেনা ছত্রছায়ায় গঠন করা হয়েছিল মুখোশ বাহিনী বা তথাকথিত ‘পিপিএসপিসি’।

স্বাধিকার পত্রিকায় এই সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সে সময় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই বাহিনী গঠনের সেনা উদ্দেশ্য সসম্পর্কে বলা হয়েছিল- ‘যুদ্ধ বিরতির জন্য সেনাবাহিনী পূর্বেকার মতো বর্তমানে সরাসরি মাঠে নামতে পারছে না। তাই তারা এখন পর্দার আড়ালে থেকে ধ্বংসাত্মক ও ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। নতুন পরিস্থিতিতেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জারী রাখার এটি একটি তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সীর কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছিলো, কাটা দিয়ে কাটা তোলার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে জুম্ম সমাজের পচে যাওয়া, অধঃপতিত সমাজ বিরোধী কতিপয় দুশ্চরিত্র ও লম্পটদের দিয়ে এই মুখেশবাহিনী গঠন করা হয়েছে। তবে একইসাথে এই মন্তব্যও করা হয়েছিলো যে, এই সন্ত্রাসী বাহিনী টিকবে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কিন্তু তাদের এই কৌশল অচিরেই মুখ থুবরে পড়তে বাধ্য। কারণ দিকে দিকে এইসব মুখোশধারী সন্ত্রাসী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে প্রবল গণপ্রতিরোধ শুরু হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা আরো জোরদার হবে। সংগঠিত জনগণের প্রতিরোধের মুখে সব ধরনের কৌশলই পরাস্ত হতে বাধ্য।’ উক্ত প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়েছিল, ‘জনগণই শক্তির উৎস।’

# সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ‘মুখোশ বাহিনীর’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনতার লাঠি মিছিলের ছবি। জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পরে সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী মুখোশ বাহিনীকে ভেঙে দিতে বাধ্য হয়।  ছবিটি ১৯৯৬ সালে  তোলা। # ফাইল ছবি

এবং দেখা গিয়েছে, ১৯৯৫ সালে গঠিত এই ভাড়াটিয়া বাহিনী এক বছর যেতে না যেতেই জনগণের তীব্র প্রতিরোধের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। এই সন্ত্রাসী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হওয়ার কালে পার্বত্য ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিলো প্রতিবাদী জনগণের উত্থানপর্বের। সন্ত্রাসী বাহিনীকে প্রতিরোধে জুম্ম নারী সমাজ এগিয়ে এসেছিলো হাতে লাঠি, ‘বিয়োঙ’ নিয়ে। তারা হাজারে হাজারে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিলো। তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতা বিম্বিসার খীসাকে জামতলা গ্রামে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করতে গিয়েছিল মুখোশ বাহিনীর পান্ডারা। কিন্তু জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধে সন্ত্রাসীদেরকে সেনা-পুলিশের প্রহরায় পালিয়ে যেতে হয়েছিলো। মুখোশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সেই প্রতিরোধের ‘উজও উজো’ ধ্বনি গগণ বিদারিত করেছিল। সেই ধ্বনি, উজও উজো সেই মর্মভেদী আওয়াজ মাইলের মেইল পেরিয়ে খাগড়াছড়ির খপংপুজ্জ্যা গ্রাম থেকে শুরু হয়ে সীমান্তের গ্রাম ধুধুকছড়ায় গিয়ে পৌঁছেছিলো। তারপরে জনগণের সেই প্রতিরোধে মুখোশ বাহিনী পাততাড়ি গুটিয়েছিল। সেনাবাহিনী ভয়ে ত্রটস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা আশংকা করেছিল, জনগণের এই প্রতিরোধ না জানি পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে কোনো সুনামি সৃষ্টি করে কীনা! তাই তারা মুখোশ বাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।

কিন্তু তার আগে সেনাবাহিনী মুখোশ বাহিনীকে আশ্রয় প্রশ্রয় ও সার্বিকভাবে সহযোগিতা দিয়েছিল। খাগড়াছড়িতে সেনারা মুখোশদের দিয়ে পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ-এর বিরুদ্ধে ভূয়া মিছিল করিয়েছিল, ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করিয়েছিল, এবং এমনকি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সাথেও সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই সাক্ষাতের ছবি এখনও পত্রিকার পাতা উল্টালে পাওয়া যাবে। মুখোশরা এক সময় জেলা প্রশাসকের অফিস পর‌যন্ত ভাঙচুর করেছিল, কিন্তু সেনাদের হস্তক্ষেপের কারণে ডিসি দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তাকে অসহায়ের মতো সবকিছু চেয়ে থাকতে হয়েছিল।

মুখোশদের বিরুদ্ধে ‘মহাশক্তিধর’ সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকার পরও কেন তারা কয়েক মাসের মধ্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছিল? মুখোশরা টিকতে না পারার কারণ প্রথমত ও প্রধানত গণ প্রতিরোধ। খাগড়াছড়ির জনগণ এবং বিশেষত নারীরা এদের প্রতিরোধ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নেমেছিলেন। দ্বিতীয়ত, মুখোশদের নীতি-আদর্শ বলতে কিছুই ছিল না, তারা কেবল টাকার লোভে সেনাদের সৃষ্টি করা এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তৃতীয়ত, তাদের সামান্যতম জনসমর্থন ছিল না। চতুর্থত, সেই সময়টা ছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ গণতান্ত্রিক পাহাড়ি সংগঠনগুলোর উত্থানের সময়। এই সংগঠনগুলোর তখন বিপুল জনপ্রিয়তা। তাদের নেতৃত্বে জনগণের সাহস, মনোবল এবং উদ্যোগ-উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। এইসব কারণে তারা আর্মিদের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার পরও গণআন্দোলনের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। জনগণ সংগঠিত হয়ে লড়াই করলে যে কোন অপশক্তি পরাজিত হতে বাধ্য – এই সত্য মুখোশদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তখন আর একবার প্রমাণিত হয়েছিল।

কিন্তু, ইতিহাস যেন বারে বারে ফিরে আসে! তবে ফিরে আসে প্রথমে ‘ট্রাজেডি’ হিসেবে, দ্বিতীয় বারে তার পরিণতি হয় ‘প্রহসনে’। মুখোশ বাহিনীর গঠন ও নিশ্চিহ্ন হওয়ার ২২ বছরের মাথায় আবার ২০১৭ সালের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আরেকটি ‘নব্য মুখোশ বাহিনী’ গঠন করা হয়েছে। সেনা মদদপুষ্ট এই সন্ত্রাসী দলটি গঠন করা হয়েছে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইউপিডিএফএর লড়াইকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু, জনগণ জেনে গিয়েছে ক্যান্টনমেন্টের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় গড়া এই বাহিনীর কথা। এই বাহিনীর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের গালভরা মন্তব্য বক্তব্যে যা-ই থাকুক না কেন, এই বাহিনী যে জুম্ম ধ্বংসের লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে, তা পার্বত্যবাসী তথা দেশবাসীর কাছে আজ পরিষ্কার।

তাই জনগণের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াও সময়ের ব্যাপার মাত্র। ১৯৯৫ সালে মুখোশ বাহিনীর কিংবা লক্ষ্মীছড়িতে ২০০৯ সালে সেনা-সৃষ্ট বোরকা পার্টির যে করুণ পরিণতি ঘটেছে, নব্য মুখোশ বাহিনীরও একই পরিণতি ঘটবে। এতে কারোর বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ যেসব কারণে ১৯৯৫ সালের মুখোশ বাহিনী ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেই একই কারণ ২০১৭ সালের নব্য মুখোশ বাহিনীর ক্ষেত্রেও পুরো মাত্রায় বজায় রয়েছে। (সমাপ্ত)
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More