রাঙ্গামাটিতে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের উদ্বেগ প্রকাশ

0

সিএইচটিনিউজ.কম
chtcommissionরাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সহিংস হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন(সিএইচটি কমিশন)।

বুধবার কমিশনের কো চেয়ার এরিক এভিব্যুরি, সুলতানা কামাল ও এলসা স্টামাতোপৌলৌ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগের কথা জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, গত ১০জানুয়ারি রাঙ্গামাটিতে নতুন মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের প্রতিবাদ সমাবেশের ওপর সরকার দলীয় সংগঠন ছাত্রলীগসহ অন্যান্য দলগুলোর ক্যাডারদের হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কারণ দেখিয়ে স্থানীয় প্রশাসন শহরের পৌরএলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় ভেদভেদী, চম্পকনগর, ট্রাইবেল আদাম, বনরূপা, আনন্দ বিহার এবং অন্যান্য এলাকায় পাহাড়িদের ঘরবাড়ী দোকানপাটের ওপরে একদল বাঙালি সহিংস হামলা করে। এবং এর ফলে বাঙালি-পাহাড়ি সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হয়। এভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং তাঁদের সংগঠনগুলোর গণতান্ত্রিক কর্মসূচীতে বাধাদানের ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই সময়ে পার্বত্য এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বাস্তবে কতটুকু উপকৃত হবে তার কোনবস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণ এখনও হয়নি। বরঞ্চ, এমন ধারণা করা অমূলক নয় যে এ অঞ্চলের বাইরে থেকে আরও অ-পাহাড়ি শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামে চলে আসতে পারে এবং পাহাড়িদের ওপর বৈষম্য আরও বাড়বে। আমাদের মতে, পাহাড়ি জনগণ যথার্থভাবেই মনে করেন যে এ-পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার চেয়ে আরও বেশী জরুরী কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অনেক দেরীতে হলেও সরকারকে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সত্যিকারের আন্তরিকতা ওনিষ্ঠা (কমিটমেন্ট) দেখাতে হবে। চুক্তি সম্পাদনের পর ১৭ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও ভূমি কমিশনকে যথাযথভাবে কাজ করারক্ষমতা দেয়া হয়নি যাতে করে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে পাহাড়িদের নিজস্ব জায়গাজমি ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদগুলোকে যথাযথ কর্তৃত্ব ও অর্থবল প্রদান করা হয়নি যাতে করে এ-প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হতে পারে।

এতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে এপর্যন্ত সংঘটিত সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার দৃষ্টান্ত একান্তই বিরল।বরং পাহাড়িদের মৌলিক অধিকার হরণের সাথে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষযোগসাজশের অভিযোগের ব্যাপারে কোন নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য তদন্ত প্রক্রিয়া ঘটেনি এবং এসবের যথাযথ প্রতিকার হয়নি। এর ফলে পাহাড়িদের ওপর অবাধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটে চলেছে। রাঙ্গামাটির বর্তমান ঘটনার ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয় যে মেডিকেল কলেজ উদ্বোধনের পক্ষ ও বিপক্ষ গ্রুপ হিসেবে সরকার দলীয় ছাত্রলীগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে অতি দ্রুত পাহাড়ি-বাঙালির সাম্প্রদায়িক বিরোধে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তবে, পাহাড়ীদের প্রতিবাদ দমন করতে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটানোর ব্যবস্থা করা হয়। অন্যদিকে, আশার বিষয় হলো যে ট্রাইবেল আদাম ও কাটা পাহাড় এলাকায় স্থানীয় বাঙালিরা পাহাড়িদের বাড়ীঘরের ওপর বহিরাগত বাঙালিদের হামলা প্রতিরোধ করেছে। তা’সত্ত্বেও রাঙ্গামাটি ঘটনা থেকে এটা প্রতীয়মান যে পাহাড়িরা নির্ভয়ে তাদের কোন কর্মসূচী গ্রহণ ও পালন করতে পারছে না। যেকোন ধরনের প্রতিবাদী কর্মসূচীতে তারা প্রশাসন এবং উগ্রপন্থী বাঙালি সংগঠনগুলোর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে নয়তো নৃশংসভাবে হামলার শিকার হচ্ছে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব সমস্যার মূলেই রয়েছে দীর্ঘকালের পুঞ্জিভূত পাহাড়িদের ভূমি অধিকারহরণ সম্পর্কিত সমস্যাটি। মেডিকেল কলেজের বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। শান্তিচুক্তির ধারা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সরকারের আলোচনা করার শর্ত থাকলেও এক্ষেত্রে সেটি অনুসরণ করা হয়নি। এভাবে স্থানীয়দের মতামত না নিয়ে এবং চুক্তি লংঘন করে জোর করে চাপিয়ে দেয়া সরকারি সিদ্ধান্তের ফলেই পাহাড়ী জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা, তাদের সাংবিধানিক অধিকারের ভিত্তিতেই এর প্রতিবাদ করতে চেয়েছে। তাদের এই অধিকারটুকু হরণের জন্যেই পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা কাঠামোর যোগসাজশে এই সহিংসতা ঘটানো হয়েছে। প্রশ্ন ওঠে যে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক পার্টির ছাত্র সংগঠনকে কেন শান্তিপূর্ণ মিছিল করে প্রতিবাদ করতে দেয়া হবে না? কেন তাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ হামলা করবে? সর্বোপরি, কেন এই রাজনৈতিক মতভেদকে সুপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ী-বাঙালি সংঘর্ষে রূপান্তরিত করা হবে?

এ ধরনের অপচেষ্টা থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যাগুলো দিনদিন বেড়ে চলেছে। খাগড়াছড়ির বাবুছড়ায় ও বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে বিজিবি কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও পাহাড়িদের বিরুদ্ধে একই ধরনের সহিংসতা ঘটানো হয়েছে। সরকার কর্তৃক এ ধরনের ধারাবাহিক ভূমি দখলের কারণে পাহাড়িদের মধ্যে আস্থার গভীর সংকট তৈরি হচ্ছে। রাঙ্গামাটির সাম্প্রতিক ঘটনাটিও একদিনের উত্তেজনা থেকে নয়, বরঞ্চ দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অনাস্থার কারণে পাহাড়ীদের প্রতিবাদের রূপ নিয়েছে।

বিবৃতিতে রাঙ্গামাটি, তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল এবং তাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পাহাড়ে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক অংশগুলোর দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে এবং অনতিবিলম্বে সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, চুক্তির সাথে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরোধাত্মক ধারাগুলোর সংশোধনের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া; কমিশনের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান কর্তৃক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে সম্পূর্ন নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সেজন্য পাহাড়িদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে পাহাড়ি ও বাঙালির সমন্বয়ে মিশ্র পুলিশবাহিনী এবং গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেয়া, যারা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা, কোন প্রকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়, সব সম্প্রদায়ের সাথে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে উত্তরণ ঘটানো এবং হামলার ঘটনায় যারা আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রশাসনকে তাদের যথাযথ চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানানো হয়েছে।
—————-

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More