রামগড়ের কর্নেল বাগান: পাহাড়িদের এক দীর্ঘশ্বাস

0

সিএইচটিনিউজ.কম

।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।। কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটেল-এ Primitive accumulation বা আদিম সঞ্চয়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কীভাবে ইউরোপে এবং বিশেষত ইংল্যান্ডে সাধারণ জনগণকে তাদের সাধারণ ভূ-সম্পত্তি থেকে উৎখাতপূর্বক সর্বহারায় পরিণত করে পুঁজি গঠন করা হয়েছে তার আলোচনা রয়েছে। অন্যান্য দেশেও আমরা আদিম সঞ্চয়ের একই রূপ দেখতে পাই। পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই আদিম সঞ্চয়ের শিকার হয়ে পাহাড়িরা কীভাবে শোষিত সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে তার একটি খণ্ডিত চিত্র এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

মানিকচন্দ্র পাড়ার কার্বারী পুস্ত কুমার ত্রিপুরার স্ত্রী কেনুবালা ত্রিপুরা
মানিকচন্দ্র পাড়ার কার্বারী পুস্ত কুমার ত্রিপুরার স্ত্রী কেনুবালা ত্রিপুরা

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও বন পাহাড়িদের সম্প্রদায়গত যৌথ সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। এখানে জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা বৃটিশরাই প্রথম নিয়ে আসে। এরপর থেকে যৌথ মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবস্থা চলে আসছে। কিন্তু গত একশ’ বছরের অধিক কাল জুড়ে ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা প্রাধান্যে চলে এলেও, এখনো ভূমি ও বনের উপর যৌথ মালিকানার প্রথা পাহাড়িদের মধ্যে বেশ শক্তভাবে জেঁকে বসে আছে। এখনো বহু পাহাড়ি তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য বনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই সাধারণ সম্পত্তি থেকে তাদেরকে উৎখাত করার প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে জারী রয়েছে। কখনো উন্নয়নের নামে, কখনো ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ গঠনের নামে, আবার কখনো সেনা স্থাপনা নির্মাণের অজুহাতে পাহাড়িদেরকে তাদের এই যৌথ মালিকানাধীন সাধারণ সম্পত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পর এই সম্প্রদায়গত ভূমি আত্মসাৎ বা বেদখল বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে, বরং তা আরো জোরদার হয়েছে।

ভূমিকা দীর্ঘ না করে এখন আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় মানিকচন্দ্র কার্বারী পাড়া, জুমছড়া কার্বারী পাড়া, বুদ্ধধন কার্বারী পাড়া, কুমিন্দ্র কার্বারী পাড়াসহ আরো বেশ কিছু পাড়া বা গ্রাম নিয়ে হচ্ছে পাতাছড়া এলাকা। এই এলাকাটি প্রধানত: ত্রিপুরা জাতি অধ্যুষিত। তবে চাকমা জাতির লোকদেরও বসতি আছে এখানে। এই এলাকার ত্রিপুরা ও চাকমা অধিবাসীরা জাতিগত ভেদাভেদ ছাড়া সুখে দুঃখে একসাথে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে। নিজেদের কৃষি জমিতে ফসল ফলিয়ে আর টিলায় চাষবাস করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। এলাকার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক বন। এই বনের মালিকানা কেউ এককভাবে ভোগ করে না। এই বনের মালিক এলাকাবাসী সকলে। অর্থাৎ বনে তাদের প্রত্যেকের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। গ্রামের লোকজন নিজেদের প্রয়োজনে গাছ, বাঁশ, বন্য তরকারি ইত্যাদি এই বন থেকে সংগ্রহ করে থাকে — এটাই পাহাড়িদের শত বছরের প্রথাগত নিয়ম। এই নিয়ে গ্রামের কার্বারীদের মধ্যে অর্থাৎ গ্রাম প্রধানদের মধ্যে কোন প্রকার দ্বন্দ্ব নেই, যদি ছোটখাট কোন ঝামেলা বা বিরোধ দেখা দেয় তাহলে গ্রামের কার্বারীরা মিলে তা মিটিয়ে দেয়। সকলে গ্রামের কার্বারীদের নেতৃত্ব মেনে চলে।

কিন্তু আজ বনের উপর এই প্রথাগত অধিকার, নিজেদের উর্বর কৃষি জমি আর চোখ-জুরানো ছোট ছোট টিলা-ভূমি পাহাড়ি অধিবাসীদের জন্য যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এবং কীভাবে নিজেদের ভূমি নিজেদের জীবনে হুমকী হয়ে দাঁড়িয়েছে সে কথা জানা যাক।

ঘটনার শুরু বেশ কয়েক বছর আগে থেকে, যখন গত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০ দশকে সমতল জেলা থেকে বাঙালি সেটেলারদের এনে এই এলাকায় বসিয়ে দেয়া হলো। তখন থেকে এই এলাকার পাহাড়িদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে শুরু হলো। তারপরও জীবন চলছিল কোনমতে। কিন্তু গত দুই বছর আগে পাহাড়িদের ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত যৌথ মালিকানাভুক্ত জমিতে ‘কর্ণেল বাগান’ নামে একটি বিশাল বাগান সৃষ্টি হবার পরপরই এখানকার পাহাড়িদের জীবন-জীবিকার উপর সরাসরি আঘাত নেমে আসে।

পরশুরাম ঘাট এলাকায় ৯০ একর তৃতীয় শ্রেণীর জমি নিয়ে এই ‘কর্নেল বাগান’। কামরুল হক নামে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এই বাগান গড়ে তোলেন। এ কারণে এলাকায় বাগানটি ‘কর্ণেল বাগান’ নামে পরিচিত। গত বছর তার ছেলে সামিউল হক এখানে আম ও লিচু গাছ লাগান। সামিউল হক কে, কোথায় তার নিবাস তা এলাকার লোকজন কেউ জানে না। তারা শুধু জানে এই কর্নেল বাগানের মালিক সামিউল হকের পিতা, যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তার খুটির জোর হচ্ছে পূর্বে কর্নেল থাকার সুবাদে বর্তমানে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে তার ঘনিষ্ট সংযোগ। এই কর্নেল বাগান দেখাশুনা করে থাকে জুনাব আলী নামে এক সেটলার বাঙালি। সে এখন এই এলাকায় পাহাড়িদের কাছে এক মূর্তিমান আতংক। জুনাব আলীর ভাষ্যমতে কর্নেল বাগানের বয়স মাত্র দুই বছর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দুই বছরের মধ্যে কিভাবে ৯০ একর জায়গা জবরদখল করে এত বড় বাগান করা সম্ভব হলো? এই জায়গার মালিক ইতিপূর্বে কারা ছিল, পূর্বের মালিকরা কি তার কাছে জমি বিক্রি করেছে? এ রকম নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এলাকাবাসী জানাল, এই সব জায়গার বেশীর ভাগ মালিক হচ্ছে গরীব পাহাড়িরা। আগে এখানে ছিল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন। যুগের পর যুগ ধরে বংশ পরম্পপরায় পাহাড়ি গ্রামবাসীরা এই বন নিজেদের প্রয়োজনে সম্মিলিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার করে আসছিল। এই কমিউনিটি বন প্রশাসনের সাথে যোগসাজশে বেদখল করে তথাকথিত ‘কর্ণেল বাগান’ সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্প্রদায়গত যৌথ মালিকানার জমি ছাড়াও কিছু পাহাড়ির ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিও এই বাগানের সাথে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা উক্ত কর্নেল অথবা তার পুত্র জোরপূর্বক দখল করেন। এইভাবে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে রাতারাতি ৯০ একর (প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে জায়গার পরিমাণ ১০০ একরের বেশী হতে পারে) এলাকা জুড়ে বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। কর্ণেল বাগানের মালিকদের লোভের লকলকে জিহবা অনেক লম্বা। তারা ওই ৯০ একর নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, তারা এখন বাগান-সংলগ্ন যে সব জমি এখনো পাহাড়িদের মালিকানায় আছে সে সব জমিও কেড়ে নিয়ে বাগানের সাথে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।

এলাকাবাসীর মতে, গভীর রাতে সেনাবাহিনী পাহাড়িদের ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে এই কর্নেল বাগানের সন্ত্রাসী বাহিনীকে সহায়তা করে যাচ্ছে। তল্লাশির নামে এই হয়রানির উদ্দেশ্য হলো পাহাড়িদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দেয়া, তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্থ করে রাখা, যাতে তারা এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস না পায় এবং এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ বছরের (২০১৪ সাল) শুরু থেকে এই অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। এই এলাকার অনেক পাহাড়ি অধিবাসী এখন বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে ঘরছাড়া-গ্রামছাড়া। অনেককে জেল হাজত-বাস করতে হয়েছে ও হচ্ছে।

কর্নেল বাগানের পরিধি বাড়ানোর জন্য পার্শ্ববর্তী গ্রামের পাহাড়ি বাসিন্দাদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাও বেশ লক্ষণীয়। পাহাড়িদের বাকি জমি জবরদখল করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরবালা ত্রিপুরা নামে মানিকচন্দ্র কার্বারী পাড়ার এক নারী জানান, “কর্ণেল বাগানের কেয়ারটেকার প্রথমে আমাদের কাছে প্রস্তাব পাঠায় আমাদের জমি-টিলা যেন তাদের কাছে বিক্রি করে দিই। আমরা রাজি না হওয়ায় তারা আমাদের উপর নানাভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে।” বর্তমানে পরবালা ত্রিপুরার মাত্র ৫ একর টিলা-জমি অবশিষ্ট আছে। এই টিলাতে চাষবাস করে তার কোনরকমে সংসার চলে। এই শেষ আশ্রয় থেকেও তাকে উৎখাত করতে চাইছে কর্নেল বাগানের মালিক।

সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনও কর্নেল বাগানের মালিকের এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। সলিন্দ্র ত্রিপুরা নামে অপর এক গ্রামবাসী এ সম্পর্কে জানান, “গত ১৪ মার্চ রাত ১২ টার সময় জুনাব আলীর নেতৃতে কর্নেল বাগানের কর্মচারীরা আমাদের গ্রাম জুমছড়ায় হামলা চালায়। তারা আমার বাড়ী পুড়িয়ে দেয়। বাড়ী পুড়িয়ে দেবার সময় তারা আমার স্ত্রীকে অসৎ উদ্দেশ্যে বাগানের দিকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার স্ত্রীর সাথে দুধের বাচ্চা থাকায় তাকে নিয়ে যেতে পারে নি। তারা আমাদের বাড়ী পুড়িয়ে দেবার পর পরই নিজেরাই বাগানের সিকিউরিটি চৌকির ছাউনি পুড়িয়ে দেয়, আর পরদিন থানায় আমাদের বিরুদ্ধে ঘরপোড়ার মামলা রুজু করে। এই মামলার আসামী হিসেবে তারা দেবেন্দ্র দা আর কুমেন্দ্র দাদাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এসব তারা করছে সেনাবাহিনী আর প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনও চায় আমরা আমাদের পিতৃভূমি থেকে চলে যাই।”

উক্ত মিথ্যা ঘরপোড়া মামলায় মানিকচন্দ্র পাড়ার দেবেন্দ্র ও কুমেন্দ্র ত্রিপুরা এক মাসের অধিক কাল জেলে অন্তরীণ থাকার পর বর্তমানে জামিনে মুক্ত হলেও বাকিদের মাথায় এখনও গ্রেফতারের খড়গ ঝুলে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই মিথ্যা মামলায় এলাকার সব গ্রামের কার্বারীদের নাম আসামী হিসেবে এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে – ‘এইসব আসামীরা এই এলাকার ভূমি দস্যু’। অর্থ্যাৎ এই মামলা অনুযায়ী এই এলাকার সকল কার্বারী ‘ভূমি দস্যু’ এবং যে কোন মুহুর্তে তারা গ্রেফতার হতে পারেন।

ঘরপোড়া মামলা ছাড়াও অপর একটি বানোয়াট মামলায় মানিকচন্দ্র পাড়ার কার্বারী ও তার জামাই এখন খাগড়াছড়ি জেলে। এই মামলা সম্পর্কে মূলকথা হলো এইরূপ: গত ১৬ এপ্রিল ২০১৪ মানিকচন্দ্র পাড়ার কার্বারী পুস্ত কুমার ত্রিপুরা এবং তাঁর মেয়ের জামাই চাইলা মারমাকে গভীর রাতে সেনাবাহিনী আটক করে এই অভিযোগে যে, কার্বারীর বাড়ীর ধানের গোলায় একটা রিভলভার ও গুলি পাওয়া গেছে। এরপরে পুলিশের হাতে তাদেরকে সোর্পদ করে থানায় একটা অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয় তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে। মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, এই মামলার স্বাক্ষী হচ্ছেন কার্বারীর নিজের স্ত্রী কেনুবালা ত্রিপুরা স্বয়ং। অর্থ্যাৎ নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী সাক্ষী। কিন্তু সরোজমিনে তদন্ত করে যা জানা গেল তা ঢাকার বাঙলা ফিল্মের কাহিনীকেও যেন হার মানায়।

এই কাহিনী জানার জন্য কেনুবালার নাতিদীর্ঘ ভাষ্য উদ্ধৃত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তিনি জানান:

“সেদিন রাতে আমরা সবাই ঘুমিয়ে ছিলাম। গভীর রাত তখন, ‘ও দাদা ও দাদা ’বলে চিৎকার করে কে যেন ডাকছিল আর দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। প্রায় রাত দুটো বাজে তখন, আর বলছিল ‘দরজা খোলো, দরজা খোলো’। আমরা ভয় পেয়ে চুপ করে ছিলাম, আর ভাবছিলাম ‘কে হতে পারে।’ বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা এবার বললো ‘দরজা না খুললে আমরা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকবো।’ এইবার আরো বেশী ভয় পেয়ে আমার মেয়ের বাবা লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলতে বললো । আমরা বাড়ীর সকলে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তারপরও আমি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখি চারিদিকে সেনাবাহিনী শুধু সেনাবাহিনী। আমাদের বাড়ী চারিদিকে ঘিরে রেখেছে তারা। আমাকে দেখে একজন সেনা জিজ্ঞেস করলো ‘আপনার বাড়ীতে কয়জন লোক আছে?’ আমি উত্তর দিলাম ‘আমরা বাড়ীতে ৫ জন, আর আমার বড় মেয়ে ও তার জামাই আছে। ওরা বৈসুতে বেড়াতে এসেছে খাগড়াছড়ি থেকে।’ শুনে সেনাবাহিনী সবাইকে ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে যেতে বললো। তাদের কথামত বাধ্য হয়ে আমরা সবাই ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু একটু পরে আমি সাহস করে সেনাবাহিনীর সাথে তর্ক করে ঘরের ভিতর চলে গেলাম তারা আমাদের বাড়ীতে কী করতে এসেছে সেটা দেখার জন্য। ঘরের ভিতর তাদের সাথে সাথে থাকলাম। অবশ্য ওরা জোর করে আমাকে বের করে দিতে চাইলো, কিন্তু আমি বললাম ‘আমাকে মারলে মার, আমি আমার ঘরে থাকবো।

“এরপর আর্মিরা আমাদের ঘরের ভিতর কাপড়-চোপড়, বিছানা তছনছ করে চেক করতে লাগলো। কী খুঁজতে তারা আমাদের বাড়ীতে এসেছে সেটা আমরা জানি না। তাই প্রথম থেকে তাদের মতিগতি আমার সন্দেহ হচ্ছিল, আগে এভাবে কোনদিন তারা আমাদের বাড়ীতে আসেনি। আজকে হঠাৎ করে — তাও আবার গভীর রাতে — আসাতে আমার সন্দেহ হচ্ছিল। আজকে কিছু একটা করবে এই সন্দেহ থেকে আমি তাদের সাথে সাথে থাকলাম। সেনাবাহিনীর সাথে মুখে গামছা বাঁধা দুজন লোক ছিল। আমি তাদের দিকে চেয়ে থাকলাম। তারাও আমার দিকে একটু পর পর দেখছিল। প্রথমে সেনাবাহিনী বাড়ীর বিছানা পত্র, ধানের গোলা ঘরের এই কোনা ওই কোনা চেক করে কোন কিছু না পেয়ে বের হয়ে আসলো। তবে বেরিয়ে আসার পর মুর্হুতে আবার ঘরে ঢুকলো। সাথে সাথে আমিও ঢুকলাম। আমি তাদের সাথে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে লাগলাম এইবার কি করে এরা। একটু পরে মুখে গামছা বাঁধা দু’জনের মধ্য থেকে একজন এসে আমাকে আড়াল করে দাড়ালো। আমি ওখান থেকে সরে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম আরেকজন মুখে গামছা বাঁধা লোক হাত দিয়ে ইশারায় কী যেন বলছে। আর আমাদের যে খালি ধানের গোলা আছে ওই লোকটি সেখানে গিয়ে কোমর থেকে আস্তে করে কি যেন বের করে ওখানেই রেখে দিল। এরপর পরেই সেনাবাহিনী সে ধানের গোলার সামনে গিয়ে ‘পেয়েছি পেয়েছি বলে’ চিৎকার করতে লাগলো। কী পেয়েছে তারা ওই খালি ধানের গোলায়? দেখালো একটা পিস্তল আর দুইটা গুলি। আমি চিৎকার করে বললাম – ‘না -এইটা ওই মুখে গামছা বাঁধা লোকটা পকেট থেকে বের করে ওখানে রেখে দিয়েছে। আমি দেখেছি।’

“সেনাবাহিনীর সাথে আমি তর্কাতর্কি করতে লাগলাম, আর বলতে থাকলাম ‘তোমরা এই পিস্তল আর গুলি আমার ধানের গোলায় রেখে দিয়েছো, আর এখন আমার স্বামীকে আমার মেয়ের জামাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছো।’ তখন সেনাবাহিনী আমাকে ধমক দিয়ে বলে ‘চুপ বেটি, বেশী কথা বললে খারাপ হবে।’ আমাদের ধানের গোলা থেকে পিস্তল আর গুলি আবিস্কার করার পরপরই সেনাবাহিনী কোন কথা না বলে আমার মেয়ের বাবা এবং আমার মেয়ের জামাইকে ধরে গাড়ীতে তুলে নিয়ে চলে গেলো। আমি ওই রাতের মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সেনাবাহিনীর গাড়ীর পিছে পিছে দৌঁড়াতে থাকলাম। রাস্তা পর্যন্ত গেলাম। আর চিৎকার করে বললাম ‘আমারেও নিয়ে যাও।’ সেনাবাহিনী আমাকে বললো, ‘আরো আসলে এই লাথি দিয়ে মার দেবো।’ সব সত্য জানার পরও আমি সেনাবাহিনীর হাত থেকে আমার মেয়ের বাবা আর মেয়ের জামাইকে রক্ষা করতে পারলাম না।। আমার মেয়ের বাবা আর মেয়ের জামাইকে সেনাবাহিনী তাদের গাড়ীতে তুলে নিয়ে চলে গেলো।

“পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা আমাদের বাড়িতে এলো কী হয়েছে খোঁজখবর নিতে। আমি তাদের কয়েকজনকে সাথে নিয়ে রামগড় থানায় গেলাম। সাথে ত্রিপুরা সংসদের একজন নেতাও ছিলেন। পুলিশরা আমাকে একটা কাগজে সাইন দিতে বললো। ওই ত্রিপুরা সংসদের নেতাও দিতে বললো। পুলিশ যেখানে সাইন দিতে বললো সেখানে সাইন দিলাম — এই আশায় হয়তো আমার মেয়ের বাবা আর মেয়ের জামাই ছাড়া পাবে। আমিতো মুর্খসুখ্খ মানুষ। থানায় বসে জানলাম আমার মেয়ের বাবা আর মেয়ের জামাইকে নাকি অস্ত্র মামলা দিয়েছে। আমাদের বাড়ী থেকে নাকি অস্ত্র আর গুলি উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। আমার পরিবার নাকি সন্ত্রাসী।”

এভাবেই সহজ সরল কেনুবালা নিজের অজান্তেই এক দাসখতে নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী হয়ে গেলেন। কিন্তু ত্রিপুরা সংসদের নেতা কেন তাকে কাগজে সাইন দিতে বললেন? এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সরকার এভাবে পাহাড়িদের গুটিকয় ‘নেতাকে’ কিছু সুবিধার বিনিময়ে হাত করে কেনুবালা, পুস্ত কুমার ত্রিপুরার মতো সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন চালায় ও তাদের জমি-জমা কেড়ে নেয়।

কেন কার্বারীদের বিরুদ্ধে মামলা?
এখানে প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক, কেন হঠাৎ করে বেছে বেছে গ্রামের কার্বারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাসহ অন্যান্য মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এর উত্তর খুবই সহজ: পাহাড়িদের গ্রামকে নেতৃত্ব শূন্য করে ফেলা আর পাহাড়িদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখা, যাতে তারা এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয় অথবা কর্নেল বাগানের মালিকের কাছে তাদের অবশিষ্ট জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পাহাড়িদের হাজার বছরের প্রথাগত ঐতিহ্য হচ্ছে কার্বারী প্রথা। গ্রামের কার্বারী মানে গ্রাম প্রধান। গ্রামের কার্বারী গ্রামের সকল সদস্যের ভালো মন্দ দেখাশুনা করেন। তার নেতৃত্ব গ্রামের সকল সদস্য মান্য করে চলেন। কার্বারী পাহাড়ের ঐক্যের প্রতীক। এটি পাহাড়ের শত বছরে প্রথাগত নিয়ম। সেই গ্রামের প্রধানকে যদি মামলা দিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস জেল হাজতে রেখে দেয়া যায় তাহলে গ্রামের অন্যান্য সাধারণ মানুষদের মধ্যে আতংক এবং এক ধরনের অসহায়-বোধ সৃষ্টি হবে। আর এর ফলে তাদের পক্ষে নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য সংগঠিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। নির্যাতিত শোষিতদের মনে ভীতির পুনরুৎপাদন ও তাদের মধ্যে গুটি কয়েকজনকে সুবিধার প্রলোভন  — এই দুই হলো শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র কৌশল, যা দিয়ে সে তার শাসন-শোষণ বজায় রাখে। [সমাপ্ত]

 

সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More