সংখ্যালঘু জাতিসমূহের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়ায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল প্রত্যাখ্যান করে কমূসূচী ঘোষণা করেছে ইউপিডিএফ

0

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিএইচটিনিউজ.কম

জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলে সংখ্যালঘু জাতিসমূহকে বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করার প্রতিবাদে এবং তাদেরকে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবিতে কর্মসূচী ঘোষণা করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ৩০ জুন: গুরুত্বপূর্ণ স্থানে লাল পতাকা উত্তোলন ও লাল পতাকা মিছিল, ৩ জুলাই: জেলা ও থানা সদরে বিক্ষোভ, ৪ জুলাই: মানববন্ধন এবং ২৯ জুনজুলাই: জাতিসত্তার স্বীকৃতির সমর্থনে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর সংগ্রহ

সংসদে উত্থাপিত বিলটি প্রত্যাখ্যান করে বিলের ব্যাপারে আপত্তির ছয়টি কারণ তুলে ধরে ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত খীসা আজ ২৮ জুন, মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসরত সংখ্যালঘু জাতির জনগণ এই উগ্রজাতীয়তাবাদী জগাখিচুড়ি সংবিধান কখনোই মেনে নেবে না৷ আমাদের পূর্ব পুরুষগণ কোন কালে বাঙালি ছিলেন না। আমাদের নিজস্ব জাতিগত পরিচয় রয়েছে এবং আমরা সংবিধানে এই পরিচিতির স্বীকৃতি চাই নিজেদের জাতিগত পরিচিতি ভিন্ন চাপিয়ে দেয়া অন্য কোন পরিচিতি আমরা মেনে নেবো না৷ এটা আমাদের ন্যায্য ও মৌলিক অধিকার

উত্থাপিত বিলের ব্যাপারে আপত্তির কারণসমূহ হলো :

১. এই সংশোধনী বিলে বাঙালি-ভিন্ন দেশে বসবাসরত অন্যান্য জাতির অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে এবং তাদের ন্যায্য অধিকারের কোন বিধান রাখা হয়নি সংখ্যালঘু জতিসমূহকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ পূর্বক তাদেরকে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ২৩ক অনুচ্ছেদ সংযোজনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে: “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজতি,ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা করিবেন” এটা হলো একটা নীতি মাত্র এবং এটি কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে৷ এ ধরনের অনেক সুন্দর সুন্দর নীতিকথা অলংকারের মতো সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে সনি্নবেশ করা আছে, যা বাস্তবায়নে সরকারের বা রাষ্ট্রের কোন বাধ্যবাধকতা নেই

২. প্রস্তাবিত বিলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের দাবি সম্পূর্ণ উপক্ষা করা হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচিতির স্বীকৃতি প্রদানের পরিবর্তে তাদেরকে বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমান সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে: “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন” এই কথার অর্থ ও তাত্‍পর্য অত্যন্ত ব্যাপক প্রথমত, এই অনুচ্ছেদের অর্থ হলো এই যে, বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোন জাতির অস্তিত্ব নেই দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বাস করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খূমী, লুসাই ও চাকসহ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসমূহের জনগণকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঙালি বলে পরিচয় দিতে হবে কারণ জন্ম ও মৃত্যুর সার্টিফিকেটে জাতীয়তার পরিচিতিতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোন পরিচিতি উল্লেখের বিধান থাকবে না তা ছাড়া, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে নিয়োগ, বিদেশ ভ্রমণ, নির্বাচন ইত্যাদি দৈনন্দিন সর্বক্ষেত্রেও তাদেরকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে হবে

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংখ্যালঘু জাতিসমূহের অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে সংবিধানের ৯ নং অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে: “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি

অথচ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংখ্যালঘু জাতির জনগণও অংশগ্রহণ করেছিলেন, যার স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার তাদের অনেককে পুরস্কৃতও করেছে

প্রস্তাবিত সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” ও রাষ্ট ধর্ম ইসলাম বলবত্‍ রাখার প্রস্তাব করে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে এটা চরম বৈষম্যমূলক, যা কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে কল্পনাও করা যায় না

৫৷ উত্থাপিত বিলে সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন অর্থাত্‍ সংগঠনের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রস্তাব করা হয়েছে এর ফলে যে কোন সংগঠনকে ঠুনকো অজুহাতে নিষিদ্ধ করা যাবে প্রস্তাবে বলা হয়েছে: “জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এ সংবিধানের পরিপন্থী হয়

৬৷ সংশোধনী বিলে কার্যতঃ একটি জগাখিচুড়ি সংবিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে এতে একদিকে চার মুলনীতির একটি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে পুনঃপ্রবর্তন ও অন্যদিকে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামকে পুনর্বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে এছাড়া, একই সাথে জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে অথচ জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত

উল্লেখ্য, গত বছর ২১ জুলাই সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারম্যান করে সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয় উক্ত কমিটির কাছে ইউপিডিএফ ৪ সেপ্টেম্বর১০ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষে ৬ দফা সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল এই প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা, সংখ্যালঘু জাতিসমূহের অস্তিত্ব ও তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সংসদীয় আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কিন্তু ইউপিডিএফ-এর সেই সব প্রস্তাবনার কোনটিই গ্রাহ্য করা হয়নি

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More