সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও তিন পার্বত্য এমপির ভূমিকা

0

রাজনৈতিক বিশ্লেষক , সিএইচটিনিউজ.কম

আসন্ন নবম সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর খসড়া উত্থাপন করা হবে বলে যুগান্তর পত্রিকায় গতকাল ৯ মে খবর প্রকাশিত হয়েছেআগামী ২২ মে এই অধিবেশন শুরু হবেপত্রিকাটি জানিয়েছে সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে

পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষ থেকে সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে৷ কিন্তু তাদের দাবি সংবিধানে স্থান পাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছেকারণ পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক খোদ প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব এ ব্যাপারে পুরোপুরি নেতিবাচকতার সরকার পাহাড়িসহ দেশের অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোকে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী” হিসেবে সংবিধানে উল্লেখ করবে বলে জানানো হয়েছেএটা বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্তাগুলোর কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না৷ এ জন্য এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে

এখন প্রশ্ন হলো, যদি বাঙালি ভিন্ন দেশের অন্যান্য জাতিগুলোকে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী” হিসেবে উল্লেখ করে সংবিধানের খসড়া সংশোধনী বিল আকারে সংসদে উত্থাপন করা হয়, তখন তিন পার্বত্য এমপির ভূমিকা কী হবে? তারা কি এর পক্ষে ভোট দেবেন, নাকি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মতো প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদ থেকে ওয়াক আউট করবেন? উল্লেখ্য, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৭২ সালের সংবিধানকে মেনে নেননিএর কারণ কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অস্বীকার করা ছিল নাতিনি বলেছিলেন ওই সংবিধানে দেশের কৃষক, শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের আশাআকাঙ্খার প্রতিফল ঘটেনি৷ সে জন্য তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের পক্ষে ভোট দেননি

লারমা সেটা করতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি দলীয় এমপি ছিলেন না তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত বর্তমান সংসদ সদস্যরা কি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারবেন? তারা কী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন? সংসদে জনগণের আশা আকাঙ্খা তুলে ধরতে পারবেন? এটা এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে

তবে যেই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন এমপি আওয়ামী লীগের খুঁটিতে শক্তভাবে বাঁধা৷ তারা লারমার মতো স্বতন্ত্র ননতারা আওয়ামী লীগের এমপি, যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এম এন লারমাকে দাঁড়াতে হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের স্বার্থ রাক্ষার প্রশ্নেঅবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তমান তিন এমপি সংসদে খসড়া সংবিধান প্রশ্নে ভোটাভুটির সময় উভয় সংকটে পড়বেনতারা যদি নিজেদের মন্ত্রীত্ব ও সংসদ সদস্যপদ রক্ষা করতে চান তাহলে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দাবি ও আশাআকাঙ্খাকে পদদলিত করে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী” পরিচিতি মেনে নিয়ে খসড়া সংবিধানের পক্ষে ভোট দিতে হবেআর তা না হলে তাদের সদস্যপদ হারাতে হবেকারণ সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, সংসদে ভোটাভুটির সময় কোন সংসদ সদস্য দলের বিপক্ষে ভোট দিলে, কিংবা ভোট দানে বিরত থাকলে কিংবা সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তার আসন শূন্য হবেএখানে পাঠকদের সুবিধার্থে নিচে ৭০ অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদ তুলে ধরা হল:

কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে

ব্যাখ্যা৷ – যদি কোন সংসদ-সদস্য, যে দল তাঁহাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করিয়াছেন, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করিয়া –

(ক) সংসদে উপস্থিত থাকিয়া ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা

(খ) সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন,

তাহা হইলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে

সুতরাং তিন এমপির সামনে দুইটি মাত্র বিকল্প: তাদেরকে হয় জাতিসত্তাগুলোর দাবি উপক্ষা করে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর” পক্ষে ভোট দিতে হবে, অথবা সংসদ সদস্যপদ হারাতে হবে৷ নিজেদের মন্ত্রীত্ব ও সংসদ সদস্যপদকে তারা প্রাধান্য দেবেন, নাকি জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে রক্ষা করবেন এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তাদের সামনে উপস্থিত। তবে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর” পক্ষে ভোট দেয়া মানে হলো জাতিসত্তাগুলোর ন্যায্য দাবি ও অধিকারকে অস্বীকার করা, নিজের জনগণের তথা স্বজাতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়াএটা করলে তারা ইতিহাসে চিরকাল ঘৃনিত, ধিকৃত ও কলঙ্কিত হয়ে থাকবেন। অপরদিকে, তারা যদি জনগণের দাবি ও স্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে ধরে “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর” পক্ষে ভোট না দেন, তাহলে তারা তাদের সংসদ সদস্যপদ হারাবেন বটে, কিন্তু তারা ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন৷ জাতিসত্তার চার এমপি কী পারবেন ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে? নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে? পারবেন কী তারা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মতো জনগণের স্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে?

কিছু দিনের মধ্যে জানা যাবে ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে তারা কার পক্ষ নেবেনতবে আমরা আজ সংসদে নিজেদের এমপি থাকার প্রয়োজনীয়তা আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করছিআজ যদি সংসদে আওয়ামী লীগের না হয়ে পাহাড়িদের নিজস্ব (স্বতন্ত্র) প্রতিনিধি থাকতেন, তাহলে জনগণের পক্ষে অনেক কাজ করা যেতো৷ সংসদের ভেতরে জনগণের পক্ষে বলা না গেলে সংসদের বাইরে বলা যেতোনিজেদের হাতের অস্ত্রকে (সংসদ সদস্যপদ) শত্রুর হাতে তুলে দেয়া চরম বোকামি ও আত্মঘাতিএই বোকামির খেসারত আমাদেরকে এখন কষে দিতে হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো দিতে হবে৷ আর কত কাল আমরা এভাবে অপরিনামদর্শীর মতো কাজ করতে থাকবো?

 

 

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More