‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ’ আটক ও ‘অস্ত্র উদ্ধারের’ তিন উদ্দেশ্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের উপদেশ

0

রাজনৈতিক ভাষ্য
ইদানিং পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ’ আটক ও ‘অস্ত্র উদ্ধার’ নাটক বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। বিড়াল যেভাবে আধমরা ইঁদুরকে নিয়ে খেলা করে, সেনাবাহিনীও নিরীহ সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ সাজিয়ে তাই করছে। প্রথমদিকে কেবল ইউপিডিএফ সদস্যদের গায়ে এসব তকমা এঁটে দেয়া হতো। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে একেবারে সাধারণ ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের কপালেও সেসব জুটছে।

তবে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ আটক ও অস্ত্র উদ্ধার পাহাড়ে নতুন নয়। এটা এখানকার সেনাবাহিনীর একটি ফেভারিট পাসটাইম অর্থাৎ পছন্দের অবসর বিনোদন বা বলা যায় প্রিয় খেলা। উদাহরণ হিসেবে ২০০৬ সালের একটি ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনাটা এ রকম: ক্যাপ্টেন জাহিদ নামে এক সেনা অফিসারের নেতৃত্বে কিছু সেনা সদস্য বিচারকের অনুমতি না নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা আদালত কক্ষে প্রবেশ করে সুশীল কান্তি চাকমা ও কমলা রঞ্জন চাকমা নামে দুই ব্যক্তিকে জোর করে বাইরে নিয়ে আসে। এরপর জাহিদ তাদের হাতে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে ছবি তোলে। এই দুই ব্যক্তিকে তার আগের দিন মহালছড়ি থেকে আটক করা হয়েছিল। খাগড়াছড়ি জেলা বার এসোসিয়েশন এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়, কিন্তু ওই আর্মি অফিসারটির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৬ সালের ৫ মার্চ।

1448543581

পাহাড়ে ‘সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ’ আটক ও ‘অস্ত্র উদ্ধার’ করার পেছনে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, এই অঞ্চলকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য হিসেবে চিত্রিত করা, যাতে এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে জায়েজ করা যায়। কারণ তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত হলেই রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার সেনা বাজেট নিশ্চিত হয়। আমরা সাধারণ জনগণ জানি না এই বিপুল পরিমাণ টাকা কোথায় যায় ও কীভাবে খরচ করা হয়। আমরা জানতে পারি না চক্ষু শিবির, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচীতে কত টাকা খরচ দেখিয়ে কত টাকা মেরে দেয়া হয়। আমরা জানিনা তথাকথিত কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নামে গোপন কী কী কর্মসূচীতে কত টাকা খরচ করা হয় ও কীভাবে খরচ করা হয়। সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ অবসানের ১৯ বছর পরও ‘মশা ও জোকের কামড়’ খেয়ে হলেও সেনাবাহিনীর পাহাড়ে থাকতে চাওয়ার কারণ হলো এই বাজেট অর্থাৎ টাকা। পার্বত্য চুক্তির আগে এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির অজুহাত ছিল ‘দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা’ রক্ষা করা, যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কোন সময় বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন করেননি। চুক্তির পর এখন অজুহাত হলো ‘সশস্ত্র সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি’। অজুহাত একটা দিতেই হবে।

সেনাবাহিনী যদি চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে এতই জেহাদ ঘোষণা করে থাকে, তাহলে পুলিশকে চাঁদাবাজির সময় হাতে নাতে ধরার পরও ছেড়ে দেয়া হবে কেন? আর কেনই বা কেবল বেছে বেছে পাহাড়ি ‘চাঁদাবাজদের’ ধরা হচ্ছে। কই বাঙালি ছাত্র পরিষদের কোন নেতা বা কর্মীকে তো আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি, যদিও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে এবং কীভাবে ও কী পদ্ধতিতে তারা এই চাঁদাবাজি করে তারও বিস্তারিত বর্ণনা দেশের জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।

‘চাঁদাবাজি’ প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার। এক. পাহাড়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ অতিরঞ্জিত। দুই. তথকথিত চাঁদাবাজির শিকার কোন ব্যবসায়ী বা অন্য কেউ আজ পর্যন্ত মামলা করেছেন বলে জানা যায়নি। তিন. আমেরিকার ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান পার্টিসহ দুনিয়ার সব দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের দেয়া চাঁদায় চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দলগুলো তার ব্যতিক্রম হবে কেন? অথচ এই অভিযোগে কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়।

সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর তৎপর হওয়ার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমন করা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যাদেরকে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ হিসেবে গ্রেফতার করা হয় তাদের সিংহভাগ হলেন ইউপিডিএফের নেতাকর্মী অথবা সমর্থক। কে না জানে দুনিয়ায় যুগে যুগে দেশে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী সংগ্রামী বিপ্লবীদের, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। ইউপিডিএ–ফ-এর নেতাকর্মীরা এর ব্যতিক্রম হবেন কেন? বস্তুত ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে সরকার ও সেনাবাহিনীর গোপন ষড়যন্ত্র বহু পুরোনো। এই পার্টির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ — জেএসএস এর আত্মসমর্পন ও সরকারের সাথে একীভূত হওয়ার পর ইউপিডিএফ-ই একমাত্র শক্তি যা জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ও সক্ষমতা রাখে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সরকার ও সেনাবাহিনীর পাহাড়ি-বিরোধী নীতি, নিপীড়ন-নির্যাতন ও ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে এই পার্টির সুসংবদ্ধ ও সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার মধ্যে। তাই ইউপিডিএফ-এর এই শক্তি খর্ব করে দিতে সরকার ও সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছে। তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণার উদ্দেশ্য হলো এটাই। অর্থাৎ ইউপিডিএফ-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অজুহাত সৃষ্টির জন্য তাকে খারাপভাবে চিত্রিত করা।

সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সেনা তৎপরতার তৃতীয় উদ্দেশ্য হলো প্রমোশন লাভ। অনেক সেনা অফিসার ‘সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ’ আটক করে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে চান। কারণ এটা তাদের পদোন্নতি লাভে সহায়ক হয়ে থাকে। জেএসএস-এর স্থানীয় পর্যায়ের এক নেতার ভাষ্য মতে, এক সেনা অফিসার বদলীর আগে ‘অস্ত্র উদ্ধার’ করতে চান, যাতে চাকুরীতে ভালো রেকর্ড দেখাতে পারেন। ওই অফিসার তাকে অনেকবার অনুরোধ করেন যাতে ভাঙাচোরা হলেও দু’একটা অস্ত্র জঙ্গলের কোথাও রেখে দেয়া হয়। তিনি পরে দলবল নিয়ে সেগুলো ‘উদ্ধার’ করবেন। বার বার অনুরোধ উপেক্ষা করা হলে এক পর্যায়ে ওই অফিসারটি তাকে হুমকি দিয়ে বলেন অস্ত্র উদ্ধার করতে না দিলে জেএসএস-এর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হবে এবং তাদেরকে কাজ করতে দেয়া হবে না। পরে উক্ত জেএসএস নেতা দলীয় কর্মকা- সচল রাখতে অস্ত্র উদ্ধার নাটক মঞ্চায়নে অংশ নিতে বাধ্য হন।

কিছু সেনা অফিসারের প্রমোশনের জন্য আজ পর্যন্ত কত নিরীহ পাহাড়িকে বলি হতে হয়েছে তার হিসাব পাওয়া কঠিন। বলতে গেলে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, বাকি সব অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা হলো সাজানো। এক কথায় সমতলে যা ‘ক্রসফায়ার’ পাহাড়ে তা ‘অস্ত্র উদ্ধার’। সবাই জানেন এসব ভূয়া। এ অন্যায় অবশ্যই বন্ধ হওয়া দরকার। সেনাবাহিনী একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনগণের ওপর অন্যায় হোক সেটা কাম্য হতে পারে না। শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ১১ মার্চ কুমিল্লায় প্রথম সামরিক একাডেমী উদ্বোধনের সময় ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে তার ভাষণে যে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়া সমীচিন হবে বলে মনে করি। তিনি ক্যাডেটদের ‘আমার ছেলেরা’ সম্বোধন করে বলেছিলেন:

‘আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালোবাসবে। মনে রেখ, তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানি মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগণের। … আর তোমরা ন্যায়ের সঙ্গে দাঁড়াবে। যেখানে অন্যায়, অবিচার দেখবে সেখানে চরম আঘাত হানবে। তোমরা যদি গুরুজনকে মেনে শৃঙ্খলা রক্ষা করে সৎ পথে চল তাহলে জীবনে মানুষ হতে পারবে। … তোমাদের মাইনে কোত্থেকে আসে? বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের ট্যাক্স থেকে। এখানে যত সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী আছেন, তাদের মাইনেও এই ট্যাক্স থেকে আসে। তোমরা সেই দুঃখী মানুষদের মালিক নও। সেবক, তাদের অর্থে তোমাদের সংসার চলবে। সুতরাং, তাদের শ্রদ্ধা করতে ও ভালোবাসতে শেখ। তোমরা অবশ্য অন্যায় দমন করবে। কিন্তু খেয়াল রেখ, নিরপরাধ লোকের প্রতি যেন অন্যায় কিছু না হয়।’ [মুনতাসীর মানুনের ‘বাংলাদেশী জেনারেলদের মন’ নামক গ্রন্থে উদ্ধৃত]

আমি বলবো, নিরপরাধ পাহাড়ি জনগণের প্রতি অন্যায় যেন সত্বর বন্ধ করা হয়।#
—————
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More