সাজেকের জনগণকে ভাতে মারার সেনা ষড়যন্ত্র
সাজেক (রাঙামাটি): সাজেকে গাড়িতে করে চাল, ডাল, তেল ও লবনসহ খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী পরিবহনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফেলে এলাকায় এসব জিনিসপত্রের সংকট দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গত ২০ ডিসেম্বর থেকে বাঘাইহাট জোনের সেনারা কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মূলতঃ পাহাড়ি অধ্যুষিত উজো বাজারকে ধ্বংস করতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
এ অন্যায় ও বেআইনী নিষেধাজ্ঞার কারণে এলাকায় চাল, ডাল, তেল, নুনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে বলে তারা জানান।
গাড়িতে পণ্য পরিবহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে উজো বাজার ছাড়াও মাচালং বাজার এবং রুইলুই পর্যটন স্পটের দোকানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাজারের দোকানগুলোতে মালামাল প্রায় ফুরিয়ে গেছে। অথচ নিষেধাজ্ঞার কারণে দোকানের মালিকরা তাদের দোকানে নতুন মাল আনতে পারছেন না। ফলে সাজেকে এখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। যারা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল নয় তারা খাদ্য সংকটে পড়েছে।
অপরদিকে পরিবহণের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাহাড়িরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীও বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে তারা বর্তমানে অর্থ সংকটে পড়েছেন।
এ অবস্থা আরো কিছুদিন চলতে থাকলে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব দেখা দেবে বলে এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সিএইচটি নিউজ ডটকমকে জানিয়েছেন। তারা এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সেনাবাহিনী কেবল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে নেই। তারা কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মালামাল পরিবহণ করছে কিনা তাও তদারক করছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর সাজেকের ১০ নম্বর এলাকায় আর্মিরা দীঘিনালা বাজার থেকে ফেরা পাহাড়িদের আটকায় এবং তাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য কেনা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী নষ্ট করে দেয়।
তার একদিন আগে ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার ছিল মাচালং বাজারের হাটবার। এদিন আর্মিরা বাজারে কোন মালামাল নিতে দেয়নি। এরপর তারা ২৬ ডিসেম্বর সোমবার উজো বাজারের হাটবারে সাজেক এলাকায় গাড়িঘোড়া চলাচলে বাধা দেয়।
মূলত ৫ ডিসেম্বর থেকে বাঙালি ভাসন্যা ব্যবসায়ীদের উজো বাজারে যেতে বাধা দেয়া হলে বর্তমান সংকটের শুরু। পরে এর পাশাপাশি মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে সংকট আরো গভীর হয়। গত তিন হাটবারে ভাসন্যা ব্যবসায়ীদেরকে উজো বাজারে যেতে দেয়া হয়নি।
সাজেক ইউপি চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা ২০ ডিসেম্বর বাঘাইছড়ি টিএনও-র সাথে দেখা করে এ বিষয়ে আলাপ করেন এবং কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ রোধ করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। টিএনও এ ব্যাপারে তার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন এবং আর্মিরা সব ক্ষমতার মালিক বলে মন্তব্য করেন।
এরপর নেলসন চাকমা ২৪ ডিসেম্বর বাঘাইহাট জোনের টু-আই.সি মেজর মঈনুলের সাথে সাক্ষাত করে সমস্যার কথা তুলে ধরেন। টু-আইসি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘এখানে দুর্ভিক্ষ হতে দেব না।’
জনপ্রতিনিধিদের সাথে ব্রিগেড কমান্ডারের মিটিঙ
গত মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব-উল-আলম বাঘাইহাট জোনে সাজেকের জনপ্রতিনিধি ও মুরুব্বীদের ডেকে মিটিঙ করেন। খাগড়াছড়ি থেকে বদলীর প্রাক্কালে সাজেকবাসীর কাছ থেকে বিদায় নিতে তিনি এ সভা ডাকেন।
সভায় তিনি কাজ করার সময় ভুল ক্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেয়ার অনুরোধ জানান।
তার কথা শেষে সাজেক ইউপির মেম্বার দয়াধন চাকমা পণ্য পরিবহণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে এলাকায় যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার বর্ণনা দেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে বলেন, ‘সাজেকে বাঘাইহাট বাজারের পরে মাচালং ও উজো বাজারের দিকে গাড়িতে মালামাল পরিবহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে এলাকায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট ও খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি এবং লোকজনের সাথে কথা বলেছি। নিষেধাজ্ঞার কারণে লোকজনের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে।’
ব্রিগেড কমান্ডার উপস্থিত বাঘাইহাট জোনের কমান্ডিং অফিসার আলী হায়দার সিদ্দিকীকে দ্রুত বিষয়টি সমাধান করার নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘উজো বাজার নিয়ে পাল্টাপাল্টি করা ঠিক হবে না। আপনি টিএনও-র সাথে আলাপ করে এ ব্যাপারে উচিত ব্যবস্থা নেবেন।’
এলাকাবাসীর সাথে সিও-র সভা
ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশের পর বাঘাইহাট জোনের সিও আলী হায়দার সিদ্দিকী গতকাল ২৮ ডিসেম্বর বুধবার সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার, কার্বারী ও ব্যবসায়ীদেরকে মিটিঙে ডাকেন।
সেখানে তিনি আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কাছে অভিযোগ উত্থাপন করায় তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি তার বক্তব্যের প্রথম দিকে ধমকের সুরে কথা বললেও পরে সুর নমনীয় করেন। এরপর তিনি দয়াধন চাকমাকে কেন ওই প্রসঙ্গ তুলেছেন তার ব্যাখ্যা দাবি করেন।
দয়াধন চাকমা একই অভিযোগ পুনর্ব্যক্ত করলে সিও বলেন, ‘বাঘাইহাট বাজার খুলে দাও। তাহলে উজো বাজার, মাচালং বাজার সব বাজার চলবে। ইউপিডিএফের সাথে কথা বলে বাঘাইহাট বাজার খুলে দেয়ার ব্যবস্থা কর।’
মুরুব্বীরা বলেন, বাঘাইহাট বাজার খুলতে সময় লাগবে। কারণ জনগণের মনে অনেক ক্ষোভ আছে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়ে দেয়া হয়েছে। তাদের উপর হামলা হয়েছে। এ হামলায় বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছে। এ অবস্থায় লোকজনকে জোর করে বাজারে নিয়ে আসা যাবে না। সময় লাগবে।’
সিও বলেন, ‘শুনেছি পর্যটনের গাড়ি বন্ধ করে দেয়া হবে (পণ্য পরিবহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাল্টা হিসেবে)। সেটা করা হলে আমাদের লাভই হবে। আমাদের আর পর্যটকদের প্রটেকশনে যেতে হবে না।’
সভা শেষে ক্যাম্প ত্যাগ করে ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় কমান্ডার তাদের মধ্য থেকে কেবল মাচালং বাজারের মুরুব্বীদের আবার ক্যাম্পে ডাকেন।
এর পর তিনি তাদের বলেন, ‘আপনারা মাচালং বাজারে মালামাল নিতে পারবেন, তবে উজো বাজারে কোন মাল রেখে যেতে পারবেন না। মাল নিয়ে যাওয়ার সময় ৬ নং চেক পোস্টে অর্থাৎ বাঘাইহাট ক্যাম্পে বলে যেতে হবে কে কোন গাড়িতে এবং কী ধরনের মাল নিচ্ছেন।’
তার এ সিদ্ধান্তের পর মাচালং বাজারের ব্যবসায়ীরা খুশী হলেও উজো বাজারের ব্যবসায়ীরা ও সাজেকবাসী খুশী হতে পারেনি।
উজো বাজারের ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন করে বলেন, ‘কেন কেবলমাত্র মাচালং বাজারের জন্য নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলো? আমরা কী অপরাধ করলাম? বাঘাইহাট বাজার বয়কট করছে সাধারণ মানুষ, এতে আমাদের দোষ কী? কেন আমাদের অযথা বিনা অপরাধে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? কেন আমাদের পেটে লাথি মারা হচ্ছে? জোন কমান্ডারের এ কোন ধরনের বিচার? আমরা এর জবাব চাই।’
তারা অবিলম্বে মালামাল পরিবহণে বেআইনী নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানান।
—————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।