সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্দেশ্য কি পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা?
সিএইচটিনিউজ.কম
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেকে পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সেনাবাহিনী। সমানতালে চলছে রাস্তাঘাট উন্নয়ন। একের পর এক সাজেক পরিদর্শনে আসছেন রাষ্ট্রপ্রধানরা। এর উদ্দেশ্য কি নিরীহ পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা? এ প্রশ্ন এখন সকল সচেতন মহলের।
এ প্রশ্ন উত্থাপিত হবার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কাপ্তাই বাধের ফলে উদ্বাস্তু হওয়া লোকজন নিজেদের জমি-জমা হারিয়ে বসতি গড়েছিল প্রত্যন্ত সাজেক এলাকায়। সেখানে তারা জুমচাষ করে সুখে-শান্তিতে বাসবাস করে আসছিলো দীর্ঘ যুগযুগ ধরে। বসতি ছিল না কোন বাঙালির। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হয় সাজেক থেকে পাহাড়িদের উচ্ছেদের চক্রান্ত। ২০০৮ সালে গঙ্গারাম দোর-এ প্রায় ৩৫ পরিবার সেটলার বাঙালিকে বসতিস্থাপন করে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ। তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয় একটি সেনা ছাউনি। এসব বসতিস্থাপন করা সেটলার বাঙালিদের লেলিয়ে দেওয়া হয় পাহাড়িদের দখলীয় জায়গা বেদখলের কাজে। ফলে পাহাড়িদের সুখ-শান্তি উবে যায়। সেনাবাহিনীর সহযোগীতাঅয় সেটলার বাঙালিরা গঙ্গারাম এলাকায় পাহাড়িদের মালিকানাধীন জায়গায় ঘরবাড়ি নির্মাণ করে। এক পর্যায়ে ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রামে হামলা চালায়। এ হামলায় পাহাড়িদের ৭টি গ্রামে কমপক্ষে ৭৮টি বাড়ি পুড়ে ছাই করে দেওয়া হয়। একই বছর সেটলার বাঙালিরা লাদুমনি চাকমা নামে এক নিরীহ জুমচাষীকে কুপিয়ে হত্যা করে। কিন্তু হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে একের পর এক চালানো হয় সেনা নির্যাতন। পাহাড়িদের উপর নির্যাতন বর্ণাতীত আকারে বৃদ্ধি পায়।
এরপর ২০১০ সালে সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় সেটলার বাঙালিরা আরেকদফা ভয়াবহ হামলা চালায়। ১৯-২০ ফেব্রুয়ারী দু’দিন ধরে পাহাড়িদের গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই করে দেওয়া হয়। পাহাড়িদের ১২টি গ্রামে ৫ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে বুদ্ধপতি চাকমা ও লক্ষী বিজয় চাকমাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠে। ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ফলে সরকার ও সেনাবাহিনী গঙ্গারাম এলাকা থেকে সেটলারদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
এদিকে, পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদের চেষ্টার প্রতিবাদে স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে উঠে। তারা নিজ বসতভিটা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়। গঠন করা হয় সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটি ও নারী সমাজ নামের সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতৃত্বে বর্তমানে সাজেক এলাকার জনগণ অনেকটা সুসংগঠিত হয়ে নিজ বসতভিটা রক্ষার আন্দোলনে নিয়োজিত রযেছে। পাহাড়িদের এই সংগঠিত শক্তিকে দুর্বল করতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসন নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও পাহাড়িদের উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়ে নতুন কৌশল হিসেবে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র। হাতে নেয়া হয়েছে রাস্তা নির্মাণ সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক(?) কাজের। সেনাবাহিনীই এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর বছর খানিকের মধ্যে সাজেকে দেশী-বিদেশী পর্যটকের আনাগোনা বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবায়ন করা হবে সেটলার বাঙালি পুনর্বাসনের পরিকল্পনা। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাড়ানো হবে সেনা নজরদারি-খবরদারি। তখন পাহাড়িদের নিজ বসতভিটা ছেড়ে পালানো ছাড়া আর কোন পথই খোলা থাকবে না।
কাজেই, পর্যটনের নামে সাজেক থেকে নিরীহ পাহাড়িরা যাতে নিজ বসতভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার না হয় সবাইকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
(লেখাটি সিএইচটি নিউজ বাংলা ব্লগসাইটে ৯ ফেব্রুয়ারী বিশেষ মন্তব্য প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে সিএইচটি নিউজ বাংলার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতাসহ সিএইচটিনিউজ.কমের পাঠকদের জন্য লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হলো…)