সাজেকে বিজিবি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে পাহাড়ি উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বন্ধ করা হোক
সিএইচটিনিউজ.কম
মন্তব্য প্রতিবেদন:
বাবুছড়ার পর এবার সাজেক। বিজিবির ৫৪ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের নামে সাজেকের গঙ্গারামে ৩০ একর জমি বেদখলের ষড়যন্ত্র জোরেশোরে শুরু হয়েছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আদেশে সার্ভেয়ার উক্ত জমির জরিপ করেন। জরিপের পর রিপোর্টে তিনি লেখেন, ‘বর্ণিত স্থানটি সাজেক ইউনিয়নে স্থিত। উল্লেখিত স্থানটি প্রকাশ্য উজো বাজার এবং উপজাতীয় পাহাড়ীদের বশত [বসত] ও বাগান সৃষ্ট পূর্বক দখলে আছে দেখা যায়।’ সার্ভে করা জমির চৌহদ্দি উল্লেখ করা হয়েছে উত্তরে সাজেক রাস্তা, দক্ষিণে গঙ্গারাম টু মারিশ্যা রাস্তা ও সীমানা ছড়া, পূর্বে ফরেস্ট ও পশ্চিমে স্কুল ও উজো বাজার। উল্লেখিত স্থানে বসতবাড়ি ও বাগান থাকায় সার্ভে রিপোর্টে জনমত যাচাইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই জরিপের পর গত ১৯ জুলাই বিজিবি ৫৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. ক. শরীফ সাজেকের গঙ্গারামে তাদের ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরের জন্য জমি দেখতে যান। কিন্তু স্থানীয় জনগণের অসহযোগীতার কারণে তিনি জমি না দেখে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
অনেকে জানেন ‘রিজার্ভ ফরেস্ট’ এর অন্তর্ভুক্ত সাজেক এক সময় ঘন ও গভীর বনে আচ্ছাদিত ছিল। তখন সেখানে বাঘ, ভালুক, হাতিসহ নানা প্রজাতির পশু পক্ষী অবাধে বিচরণ করতো। সাজেকে এখন যারা বসবাস করছেন তারা সবাই পূর্বে উৎখাত হওয়া লোকজন। তাদের আদি বসতিতে তাদের প্রত্যেকের জমি ও বসতভিটা রয়েছে, যা এখন বাঙালি সেটলার কিংবা সেনাবাহিনীর দখলে। মূলতঃ ১৯৮০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা নির্যাতন, সেটলার হামলা ও ভূমি বেদখল চরম আকার ধারণ করলে দীঘিনালা, মেরুং, লংগুদুসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎখাত হয়ে তারা এখানে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তারা বহু পরিশ্রম করে ও বন্য প্রাণীর সাথে যুদ্ধ করে এখানে বসতি গড়ে তোলেন। বনবিভাগও সে সময় তার সৃজন করা সেগুন বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর জন্য তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। এমনকি এই নতুন বসতীদের মধ্য থেকে বনবিভাগ হেডম্যান১ ও কার্বারী নিয়োগ দেয়। বন বিভাগের পক্ষ থেকে তখন তাদেরকে সম্মানী ভাতাও দেয়া হতো ।২ তাই এখন যারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইছে সাজেকে বনবিভাগের জমিতে পাহাড়িরা অবৈধভাবে বাস করছে, তারা হয় সাজেকে পাহাড়িদের বসতি স্থাপনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না, অথবা জানলেও দুরভিসন্ধিমূলকভাবে সেটা গোপন রাখেন।
কিন্তু পাহাড়িরা সাজেকে এসেও এতটুকুও শান্তিতে থাকতে পারছেন না। নির্যাতন ও উচ্ছেদের রাহু যেন তাদের পিছু ছাড়তে চায় না। নতুন জায়গায় এখনো তারা থিতু হতে পারেননি, তারপরও সেখান থেকে তাদেরকে আরও এক দফা উচ্ছেদের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে উৎখাত করে সেখানে বাঙালি পুনর্বাসনের জন্য গত ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কয়েক দফা চেষ্টা চালানো হয়। কমপক্ষে দুই বার তাদের ঘরবাড়ি ও ধর্মীয় উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং গুলি করে ৪ জনকে খুন করা হয়। জরুরী অবস্থার সময় শত শত বাঙালি সেটলার পরিবারকে সেখানে নিয়ে এসে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়। সাজেকবাসীর সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে সেনাবাহিনী তাদের বিরাট অংশকে সেখান থেকে সরিয়ে নিলেও, এখনো সাজেকে পাহাড়িদের জমিতে ১৩ পরিবারকে রাখা হয়েছে।
সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যত্র বিজিবির ক্যাম্প ও ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের উদ্দেশ্য সীমান্ত রক্ষা বলা হলেও, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো একদিকে সেটলার পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণের কাজে সাহায্য করা ও পুনর্বাসিত সেটলারদের সুরক্ষা দেয়া, আর অন্যদিকে পাহাড়িদের উপর জাতিগত নিপীড়ন ও প্রভুত্ব জারি রাখতে শাসকগোষ্ঠীকে সহায়তা দেয়া। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই গত বিএনপি জমানায় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ওয়াদুদ ভূঁইয়ার পরামর্শে দীঘিনালা, পানছড়ি, মারিশ্যা, সাজেক ও গুইমারায় বিজিবির নতুন ব্যাটালিয়ন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওয়াদুদ ভূঁইয়ার মতো উগ্রসাম্প্রদায়িক ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা চায় পাহাড়িদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা — যেভাবে ইসরাইল ফিলিস্তিনে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যাতে তাদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার, গণহত্যা চালানো হলেও তারা অতীতের মতো সীমান্ত অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারে। বিজিবির এই ভূমিকা গত বছর তাইন্দং হামলায় দেখা গেছে। এই হামলার আসল রূপকার যে বিজিবি তা আজ প্রমাণিত। তারা পাহাড়িদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার সময় সেটলারদের সাথে ছিল এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর কাছ থেকে শোনা গেছে। এছাড়া টহলের নামে পাহাড়িদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, নিরীহ ব্যক্তিকে আটক, নির্যাতন ইত্যাদি সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা।
পাহাড়িদের আশঙ্কা — এবং তা অত্যন্ত যৌক্তিক — যে, বাবুছড়া ও সাজেকে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হলে তাদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন আরো বাড়বে এবং ধীর ধীরে তাদেরকে ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকা থেকে সরে যেতে হবে। অতীত ও নিকট অভিজ্ঞতা তাদের এই আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। বান্দরবানে রুমায় গ্যারিসন সম্প্রসারণের নামে পাহাড়িদের জমি কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে — যদিও গ্যারিসনের অনেক জমি এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জরুরী অবস্থার সময় বান্দরবান সদরের বালাঘাটায় অবস্থিত ব্রিগেড সদর দপ্তরের জন্যও আরো জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করা হয়েছিল। বাবুছড়া ও সাজেকে বা অন্যত্রও যে এমন হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? এ কারণে বাবুছড়া ও সাজেকে পাহাড়িরা নিজেদের জমি রক্ষার জন্য এখন মরিয়া হয়ে বাধা দিচ্ছে। বস্তুত এ ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।
সাজেকবাসীরাও বাবুছড়াবাসীদের মতো বহু অন্যায় অবিচারের শিকার। তারা ১৯৮০ দশকে উৎখাত হওয়ার আগে ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে প্রথমবার উচ্ছেদের শিকার হয়েছিলেন। উচ্ছেদ হতে হতে তারা শেষ পর্যন্ত সাজেকের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু এখান থেকেও তাদেরকে উৎখাতের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে। মনে হয় শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে ঠেলে ঠুলে একেবারে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিতে চায়। তাই সাজেকবাসীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এই অবস্থায় তাদের প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
বিজিবি বা সেনা ক্যাম্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আসল উদ্দেশ্য যে পাহাড়িদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা তা অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও বোঝা যায়। যেমন, এই ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে অন্য কোথাও নয়, পাহাড়িদের জমিতে। আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কোন ক্যাম্প বা সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য কোন বাঙালি উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন। বরং পাহাড়িদের জমিতে এই সব ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ার পর তারা তার চারপাশে বসতি গড়ে তুলেছেন।
সঙ্গত কারণে সাজেকবাসী ইতিমধ্যে তাদের জমিতে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। গত ২২ জুলাই পাহাড়িরা তাদের জমিতে একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন তাতে বাধা দেয়। কারণ বিজিবি ওই জমিতে তাদের ৫৪ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করবে বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, প্রশাসন কোন আইন বা এক্তিয়ার বলে সেখানে বুদ্ধমূর্তি স্থাপনে বাধা দিয়েছে? এই জমি প্রশাসনের নয়, বিজিবিরও নয়, এমনকি ওই জমির বন্দোবস্তী পাওয়ার জন্য বিজিবি কিংবা অন্য কোন সংস্থা আবেদনও করেনি। বড় জোর বন বিভাগ এতে বাধা দিতে পারতো, কিন্তু সেও তার সেই অধিকার হারিয়েছে, কারণ বনবিভাগ বহু আগে সেখানে পাহাড়িদের অবস্থানকে মেনে নিয়েছে। তাই বনবিভাগও এই জমি তার বলে আর দাবি করতে পারছে না। তাছাড়া বৃটিশদের আখ্যা দেয়া ‘রিভার্জ ফরেস্ট’ হলো প্রকৃতপক্ষে পাহাড়িদের যৌথ মালিকানাধীন জমি। বৃটিশরাও পরে পাকিস্তান সরকার জোর করে এই জমি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
পাহাড়িরা আর তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ হতে রাজী নয়। অতীতে বিনা বাধায় তাদের হাজার হাজার একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, তাদেরকে নিজের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়ে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। কিন্তু সেদিন এখন অতীত। এখন তারা মরিয়া হয়ে বাধা দেবে। নিজের জমি ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকার নিজেকে পাহাড়িদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে জাহির করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর বলেছেন পাহাড়ের জমির মালিক হবে পাহাড়িরাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর ওই কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং পাহাড়িরা জমির মালিক হওয়ার পরিবর্তে প্রতিদিন জমি হারাচ্ছে। ভারত থেকে ফিরে আসা পাহাড়ি শরণার্থীদের অনেককে এখনো পর্যন্ত তাদের জমি ফিরিয়ে দেয়া হয়নি।
এই অবস্থায় সাজেকসহ পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীর দাবি: অবিলম্বে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের নামে জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করা হোক। সাজেকে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের কোন প্রয়োজন নেই। কারণ বাঘাইছড়িতে ইতিমধ্যে একটি ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বিজিবির দু’টি সদর দপ্তর থাকা ঠিক নয়। তাছাড়া বিএনপি-জামাত সরকারের সময় গৃহীত দুর্নীতিবাজ ওয়াদুদ ভূইয়ার পাহাড়ি-বিরোধী কর্মসূচী বর্তমান সরকার কেন বাস্তবায়ন করবে? [সমাপ্ত]
——————
১বনবিভাগ অনুমোদিত হেডম্যান আছেন তিন জন: চিত্ত রঞ্জন চাকমা, গোবিন্দ চাকমা ও সভারাম চাকমা। তারা রাজা বা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নন।
২বনবিভাগের সেগুন বাগানে এখন আর কাজ না থাকায় তাদের ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।