সাজেক থেকে রাঙাপান্যা : প্রতিবাদ প্রতিরোধের অগ্র সেনানী নারীদের অভিবাদন!

0

।। রাজনৈতিক ভাষ্যকার ।।

৩০.৯.২০১৮

২৬ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটির শহরতলী রাঙাপান্যায় সংঘটিত সেনা ও গ্রামবাসীর সংঘর্ষের এত বড় ঘটনার কোন খবর জাতীয় পত্রিকা-টিভি চ্যানেলে প্রচার তো দূরের কথা, স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোন পত্রিকার ভিতরের পাতায়ও স্থান পায় নি। চিহ্নিত একটি ‘নিউজ পোর্টাল’ ও ‘গিরিদর্পণ’ ঘটনা বিকৃত করে প্রচার করেছে বলে এক সূত্রে জানা গেছে। এভাবে পরিকল্পিত ও নির্দেশনা মাফিক সংবাদটি ধামাচাপা দেয়া (kill) হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের বদৌলতে রাঙাপান্যার খবর ও এর ভিডিও দৃশ্য ভাইরাল হয়ে পড়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি মানুষের মন থেকে মুছে যাবার মত নয়। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য কিন্তু অনেক গভীর এবং সদূরপ্রসারী।
বুঝা যায়, ভিডিওটির দর্শক ও সমর্থক দিন দিনই বাড়ছে। ধরে নেয়া যায় আগামীতে আরও বাড়বে এবং ভিন্ন মাত্রা পাবে। যারা ভিডিও ধারণ করে আপলোড করেছে, তারা সময়োপযোগী কাজ করায় ধন্যবাদ পাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ও অন্যান্য অঞ্চলের নিপীড়ন নির্যাতনের সংবাদ বস্তুনিষ্টভাবে প্রচারিত হয় না বলে পত্র-পত্রিকার প্রতি লোকের আস্থা কম, একই কারণে বিটিভি খবর দেখার লোক থাকে না। প্রকৃত ঘটনা প্রচারের জন্য বর্তমানে প্রয়োজন হচ্ছে বিকল্প সংবাদ মাধ্যম। বিশ্বের নির্যাতিতদের আন্দোলন সংগ্রাম তুলে ধরে সমর্থন আদায়ের পেছনে রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারদের ভূমিকা অপরিসীম। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ চার দশক ধরে সংগ্রাম চললেও এ চ্যালেঞ্জিং কাজে আগ্রহী লোক দুঃখজনকভাবে কম। ফেইসবুকের ক্ষতিকর ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক থাকার পাশাপাশি এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগানোর দিকটি জোর দিতে আহ্বান জানাই।

ফেইসবুকের ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনার দিন ২৬ সেপ্টেম্বর রাঙাপান্যায় ক্রুদ্ধ নারীদের লাঠি হাতে সেনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃশ্য। প্রতিবাদ প্রতিরোধের আওয়াজ তুলে স্থানীয় নারী-পুরুষ রাস্তায় নেমে আসছে। যার বেশীর ভাগই নারী এবং তারাই সম্মুখ সারিতে (বোধগম্য কারণে পুরুষরা পেছনে), চিৎকার করে প্রতিবাদ ও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এক পর্যায়ে এক বিক্ষুব্ধ নারী হামলাকারী সেনা জওয়ানকে লাঠি দিয়ে পেটায়, যা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ঘৃণা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের এক স্বাভাবিক বিষ্ফোরণ মাত্র! মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে কী হতে পারে, এটি হচ্ছে তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। কোন সমাজের নারীরা যখন প্রতিবাদ প্রতিরোধে নামে, তখন বুঝতে হবে তার মূল অনেক গভীরে। রাঙাপান্যার ঘটনাটি সাজেকের সাড়া জাগানো ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল সাজেকে ক্রুদ্ধ নারীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসে, বাঘাইছড়ি টিএনও’র জিপ আটকায় এবং কষে লাঠিপেটা করে (২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি)।

# ফাইল ছবি

ঘটনা আরও আছে, কদুকছড়ির ঘিলাছড়িতে এক নারীর শ্লীলতাহানির প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ নারীরা রাস্তায় নেমে সেনা অধিনায়কের জিপ অবরোধ করে (২০০৯ মে ৮) এবং সেনা কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত জওয়ানকে প্রত্যাহার-সাজা দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে এলাকায় গঠিত হয় ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি। শুধু রাঙ্গমাটি নয়, খাগড়াছড়িতেও নারীদের রয়েছে প্রতিবাদ প্রতিরোধের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনা। পিসিপি কর্মী রমেল হত্যার বিচারের দাবিতে খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে আহূত মানববন্ধনে বাধা দিতে সেনা জওয়ানদের লাঠিপেটায় নারীরা পিছু হটে নি, লাঠি হাতে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে মানববন্ধন কর্মসূচি (৮ মে ২০১৭) সফল করে।

# ফাইল ছবি

সেনাসৃষ্ট মুখোশবাহিনী প্রতিরোধে লাঠি হাতে রাজপথে মিছিল (৭ মার্চ ১৯৯৫) করেছে, যা প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা জেগে উঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করেছে।

# ফাইল ছবি

রাঙাপান্যায় বিক্ষুব্ধ নারী কর্তৃক হামলাকারীকে লাঠিপেটা নিছক এক সেনা জওয়ানকে আঘাত নয়, প্রকারান্তরে তা হচ্ছে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুখে চপেটাঘাতের মত। কেন নারীরা তা করবে না? কল্পনার অপহরণকারী-বহু নারীর সম্ভ্রমহানির হোতা-লোগাঙ-লংগুদু গণহত্যার জল্লাদ-পাহাড়ে নিষ্ঠুর দমন-পীড়নে নিয়োজিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণা, ক্রোধ বারুদের মতো জমে রয়েছে। রাঙাপান্যায় এক সাধারণ নারী (যে কখনও মিছিলে যায় নি) কর্তৃক হামলকারী সেনা জওয়ানকে লাঠিপেটা, তা হচ্ছে নির্যাতিত জনতার ন্যায্য প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ মাত্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রত্যুত্তর, এক কথায় দমন-পীড়ন বন্ধের ‘লাল কার্ড’ প্রদর্শন! পাহাড়ের জনগণ আর ফাউল মেনে নিতে প্রস্তুত নয়! তারা মুখ বুঁজে অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করবে না। রাইফেল বেয়নেট মামলা-হুলিয়া ধরপাকড়ের ভয় দেখিয়ে তাদের জব্দ করার দিন শেষ। মনে রাখতে হবে, পাঞ্জাবিরা ট্যাঙ্ক ভারি অস্ত্রের সাহায্যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও ’৭১-এ পরাজিত হয়। হিটলার গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদি মেরে, অত্যাধুনিক মারাণান্ত্র নিয়েও জিততে পারে নি। ইতিহাসে বারে  বারে প্রমাণিত হয়েছে, সত্য ও ন্যায়ের জয় অনিবার্য!

ভবিষ্যতে যখন ‘সুদিন ফিরে আসবে’ অর্থাৎ যেদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সংগ্রাম জয়যুক্ত হবে এবং বাংলাদেশে প্রবর্তিত হবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা — সেদিন রাঙাপান্যাসহ অন্যান্য স্থানে যারা (নারী-পুরুষ উভয়ই) সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তারা অবশ্যই সম্মাননা লাভ করবেন (ব্রিটেনে সাধারণ নাগরিকদের সাহসিকতা বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জর্জ ক্রশ’ পদক দেবার বিধান রয়েছে)। এখন তাদের নাম প্রকাশ করাও হবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং আত্মঘাতি! মামলায় ফাঁসানোর হাজার রকমের অপচেষ্টা চলছে। রাঙাপান্যায় প্রতিবাদী নারীদের সাহসিকতার মাঝে ‘নৌকা’ ‘ধানের শীষ’ওয়ালা মুখচেনা দালালরা হঠকারিতার গন্ধ পেতে পারে। নিজেদের ‘সুশীল সমাজ’ পরিচয়দানে আগ্রহী একশ্রেণীর ব্যক্তি এ ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকায় সায় দেবে না। নানা যুক্তি দিয়ে দ্বিমত পোষণ করে জনগণের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চাইবে, এ শ্রেণীর লোকদের যোগ্যতা হচ্ছে মানুষের মনে সংশয় জাগিয়ে ভেতর থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দুর্বল করে দেয়া (উইপোকার মত)। বিনিময়ে ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে এরা সুযোগ-সুবিধা লাভ করে থাকে। শাসকচক্র এখন অনেক বেশী ধূর্ত, সমাজের তথাকথিত উচ্চস্তরের লোক বা মাথাওয়ালাদের আগে কিনে ফেলে এবং জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়।

পরাজয়বাদী আরেক শ্রেণীর লোক ইঁদুরের গর্তে বুক চাপড়িয়ে দেশপ্রেম জাহির করে থাকে, দুনিয়ায় হতাশা আর বিভ্রান্তি ছড়ানো ছাড়া এরা কিছু করতে পারে নি। ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত!’ রাঙাপান্যা ও সাজেকের সাহসী নারীরা নিজেদের কাণ্ডজ্ঞান থেকে এ মহা মূল্যবান বাণীকে বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন, তাদের জানাই অভিবাদন!

পাদটিকা : রাঙাপান্যায় সেনা ক্যাম্প করার পাঁয়তারা ফাঁস হয় ২৬ সেপ্টেম্বর। রাঙ্গামাটি ব্রিগেডের জি-টু মেজর তানভির রাঙাপান্যা স্থানীয়দের শাসিয়ে এলাকায় সেনা ক্যাম্প স্থাপনের কথা জানায়।

ঘটনার দিন সুরেশ চাকমা নামের এক মুদি দোকানদার (মোবাইল রিচার্জ দাতা+বিকাশ এজেন্ট)-কে সন্ত্রাসী হিসেবে ফাঁসাতে ছদœবেশী সেনা গোয়েন্দা ১ লক্ষ টাকার বিকাশ করতে চায়। গোয়েন্দাদের সাহায্যার্থে পরিকল্পনা মত নির্দিষ্ট দূরত্বে ছিল এক পিক-আপ সেনা জওয়ান। নিশ্চিত না হয়ে বিকাশ করতে অস্বীকার করলে গোয়েন্দার লোক তাকে চড় মারে, সন্ত্রাসী হিসেবে ফাঁসিয়ে ধরে নিতে চায়। এ সময় দোকানে তার প্রতিবাদ জানায় ক্রেতা নয়ন মণি চাকমা ও অপর দোকানদার মিসেস লাভলী ঘোষ। প্রথম দফায় সেনা জওয়ানরা তাদের তিন জনকে দোকানে আটকে রাখে, জবরদস্তি করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিতে চাপ দেয়। পাড়া পড়শী তাদের রক্ষার্থে এগিয়ে গেলে সেনা জওয়ানরা তাদের লাঠিপেটা করে, আগত নারীদের সাথে অশোভন ব্যবহার করে। ঘটনা বিদ্যুত বেগে ছড়িয়ে পড়লে আশে-পাশের লোকজন বিশেষ করে নারীরা লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হয়, সেনা দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানায়। ক্ষুব্ধ নারীরা অশোভন আচরণের জবাবে সেনা জওয়ানকে লাঠিপেটাও করে, যা ভিডিওতে স্পষ্ট। বিক্ষুব্ধ জনতার মেজাজ দেখে সেনা জওয়ানরা ধৃতদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অন্যায় অবস্থানে থাকলে অস্ত্র যে অচল, তা প্রমাণিত হয়। এক কথায় সেনা জওয়ানরা ‘চাবুরুক-না-ভুরুক’ হয়ে অর্থাৎ চরমভাবে হেনস্থা হয়ে ফিরে যায়।

পরে মেজর তানভির (রমেলের হত্যাকারী) আরও দুই পিক-আপ সেনা ও পুলিশ সাথে নিয়ে আবার এলাকায় হামলা চালাতে আসে। মেজর তানভির ‘এটাক! এটাক!’ বলে জওয়ানদের আক্রমণের নির্দেশ দেয়। ‘এখানে সেনা ক্যাম্প হবে!’ বলে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়। ‘ওসি সাহেব দুই/তিন শ’লোকের নামে কেইস দেন’ বলে ষড়যন্ত্র ফাঁস করে ফেলে। বিক্ষুব্ধ জনতা আবারও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেনা-পুলিশের আক্রমণে গ্রামবাসীদের মধ্যে বেশ ক’জন নারী-পুরুষ জখম হয়। অন্যদিকে জনতার প্রতিরোধের মুখে সেনা জওয়ানদেরও কয়েক জন গুরুতর জখম হয় বলে জানা যায়। পরে সেনারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১ জনকে ধরে নেয়, ৩ জনকে লক্ষাধিক টাকা ও মোবাইল সেট দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়। মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফাঁসিয়ে জব্দ করাই এখন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান অস্ত্র। দেশে সরকার বিরোধীদের যেভাবে মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামেও একই কারবার চললেও তা এখনও ব্যাপক প্রচার পায় নি। রাঙাপান্যার ঘটনাটি শুধু রাঙ্গামাটি নয়, সর্বত্র আলোচনা চলছে। বলা যেতে পারে এটি এখন ‘টক অব দি সিএইচটি’।#
——————-
সিএইচটি নিউজ ডটকম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More