সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই সেটলার বাঙালিরা হামলা চালিয়েছে- কাজলী ত্রিপুরা
সিএইচটিনিউজ.কম
রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলার ৩নং বুড়িঘাট ইউনিয়নের সংরক্ষিত আসনের মেম্বার কাজলী ত্রিপুরা। তাঁর বাড়ি সুরিদাস পাড়ায়। গত ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ বগাছড়িতে সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন। এ হামলায় তাঁর বাড়িও পুড়ে যায়। সিএইচটিনিউজ.কমের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন-
“ঘটনার দিন ঘুম থেকে উঠার পর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আমাকে কেউ একজন ফোন করে জানায় যে, সুরিদাস পাড়ায় নাকি কে বা কারা আনারস চারা কেটে ফেলেছে। আমি তাকে বলি আমিতো জানি না। এর কিছুক্ষণ পর দেখলাম বগাছড়ি ও ইসলামপুর থেকে অনবরত সেটলার বাঙালি আসতে শুরু করেছে। তাদের সাথে সেনাবাহিনীর ২টি গাড়িও আসে। এই দুটো গাড়ির মধ্যে ১টি শিয়াল্যা পাড়া ও আরেকটা ১৪ মাইলে অবস্থান নেয়। এরপর হঠাৎ ৩টি গুলির আওয়াজ শুনা যায়। এই আওয়াজ শুনে পাহাড়িরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়।”
“তারপরও বুকে সাহস বেঁধে আমরা বাড়িতে অবস্থান করি। আগুন লাগিয়ে দেয়া পর্যন্ত কি হতে যাচ্ছে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। যখন ১৪ মাইলের দোকানে আগুন লাগানো হচ্ছে তখনও বাড়িতে ছিলাম। বাঙালিরা যখন আমার বাড়ির পাশে আগুন লাগাচ্ছে তখন পর্যন্ত বাড়িতে থাকি। কিন্তু বাঙালিরা আমার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে আর বাড়িতে থাকতে পারিনি। আমরা ৩ জন তখন বাড়ি থেকে একটু দূরে আড়ালে লুকিয়ে পড়ি।”
“এরপর দেখলাম ৮ জন সেটলার বাঙালি এসে আমার বাড়িতে ভাঙচুর আরম্ভ করেছে এবং জানালা ভেঙে বাড়ির ভিতরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বাড়ির ভিতর ও রান্নাঘরের দিকে আগুন জ্বলতে দেখি। আগুন লাগানো শেষ করে বাঙালিরা চলে গেলে কিছুক্ষণ পর আমরা লুকানো অবস্থা থেকে বের হয়ে বাড়িতে চলে আসি। তৎক্ষণাৎ আরো কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি এবং কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব হয়। যা পুড়ে যাবার সেসব তো পুড়েই গেছে। এছাড়া গ্রামের কিছু বাড়িতেও আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়। যারা কোন কিছুই রক্ষা করতে পারেনি বর্তমানে তারা খোলা আকাশের নীচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।”
সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতেই সেটলার বাঙালিরা এ হামলা চালিয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সাথে থাকার কারণেই বাঙালিরা এ ধরনের হামলা করতে সাহস পেয়েছে।
সেটলাররা কেন পাহাড়িদের ঘরে হামলা করেছে বলে মনে হয়? এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে সেটলার বাঙালিরা আসার কারণেই আমাদের এ দুর্গতি হচ্ছে। তারা আমাদের জায়গা-জমি বেদখল করছে, আমাদের জুম্ম জাতিকে কিভাবে পার্বত্য অঞ্চল হতে উচ্ছেদ করবে, কিভাবে আমাদের জায়গা-জমি কেড়ে নেবে, কিভাবে জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করবে এই চেষ্টায় রয়েছে।
যে জায়গায় বাঙালিরা আনারস বাগান করেছে সে জায়গাটি কার? এই প্রশ্নের জবাবে তিন বলেন, এটি পাহাড়িদের(চাকমাদের) জায়গা। বাঙালিদেরকে বার বার বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তারা পাহাড়িদের জায়গায় সেগুন গাছ, কলাগাছ, আনারস চারা রোপন করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলে সেটলার বাঙালি কর্তৃক এভাবে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল হচ্ছে।
যখন বাঙালিরা ঘর পুড়ে দিচ্ছে তখন আর্মিদের কি ভূমিকা ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ঘটনার পর যখন ১৪ মাইলে যাই তখন শুনেছি আর্মিরা বলছে তারা নাকি বাঙালিদের বাধা দিয়েছে এবং পাহাড়িদের সহযোগিতা করছে। তখন আমি তাদের এ কথার প্রতিবাদ করে বলি, আমি নিজের চোখেই দেখেছি, আর্মিদের ১টি গাড়ি ১৪ মাইলে এবং আরেকটি গাড়ি শিয়াল্যা পাড়া(শিকল পাড়া) যাত্রী ছাউনীতে থাকাকালেই বাঙালিরা ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। কই আমাদের ঘরবাড়ি তো রক্ষা হয়নি। তাহলে কিভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন?” নানিয়াচর জোনের সোহেলের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা এসেছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, গত ১৬ ডিসেম্বর সকালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাঙালি সেটলাররা সংঘবদ্ধ হয়ে বুড়িঘাট ইউনিয়নের সুরিদাস পাড়া, নবীন তালুকদার পাড়া ও বগাছড়ি পাড়ায় হামলা চালিয়ে ৫০টি বসতবাড়ি, ৭টি দোকান ও ১টি ক্লাব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। একই সময় সেটলাররা করুণা বনবিহার নামে একটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা, বুদ্ধমূর্তি ভাংচুর-লুটপাট ও বিহারে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে।
————–
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।