৮ সংগঠনের প্রতিনিধি দলের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী এলাকা পরিদর্শন
সিএইচটিনিউজ.কম
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের আংক্ষ্যং (সাপমারা ঝিড়ি) এলাকায় ভূমিদস্যু কর্তৃক মারমা ও চাক পরিবার উচ্ছেদ, রাবার বাগান করার জন্য নব্য ভূমি দস্যুদের ভূমি বেদখলের চিত্র সরেজমিন পরিদর্শন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনরত ৮ গণসংগঠনের কনভেনিং কমটির একটি প্রতিনিধি দল।
সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটির সভাপতি জ্ঞানেন্দু চাকমার নেতৃত্বে ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন- গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও কনভেনিং কমিটির সদস্য সচিব অংগ্য মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও কনভেনিং কমিটির সদস্য মাদ্রী চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কনভেনিং কমিটির সদস্য থুইক্যচিং মারমা, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সদস্য কাজলী ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক এসিংমং মারমা ও সদস্য শুভ চাক।
প্রতিনিধি দলটি গত ২৪ আগস্ট সকাল ১১টায় বাইশারীতে গিয়ে পৌঁছে। এলাকার লোকজনের সাথে আলোচনার পর প্রতিধিদলের নেতৃবৃন্দ ভূমি দস্যু কর্তৃক উচ্ছেদকৃত আংক্ষ্যং পাড়া পরিদর্শন করেন।
প্রতিনিধি দলের নেতৃবৃন্দ এলাকা পরিদর্শনকালে ২৭৮ নং বাইশারী মৌজা, ২৭৯ নং বাঘমারা মৌজা ও ২৮০ নং আলেক্যং মৌজা এলাকায় হাজার হাজার একর পাহাড়ি ভূমি দখল করে রাবার বাগান করার দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তারা বলেন, শুধু এই এলাকায় যে ভুমি বেদখল হয়েছে তা নয়, এর বাইরেও সরকার দলীয় আওয়ামী লীগ এর ইউপি নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা পাহাড়িদের বংশ পরম্পরায় ভোগদখলীয় ও জুমচাষকৃত জায়গাগুলো বেদখল করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
আংক্ষ্যং আফ্যা (সাপমারা ঝিড়ি উপর) এর বাসিন্দা মংনুচিং মারমা প্রতিনিধি দলকে বলেন, আমরা বিশ বছর আগ থেকে এই আংক্ষ্যং গ্রামে বসবাস করে আসছি। আংক্ষ্যং পাড়া ও সাপামারা ঝিড়ি এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম চর্চা করার জন্য একটা বৌদ্ধমন্দির ছিলো। এই জায়গা থেকে আমাদের উচ্ছেদের আগে আমাকে বিজিবি কর্তৃক অস্ত্র রাখার অভিযোগে আটক করে নিয়ে গিয়ে বিজিবি ক্যাম্পে রাখা হয়। সেখানে অবস্থানকালে আমাদের লোকদের বসতবিটা থেকে উচ্ছেদ করে জায়গাটা আলম মাঝি ও জব্বর ফরাজী মাঝি নামে দখল করে নেয়। দখলের কারণে এখান থেকে বৌদ্ধমন্দিরসহ এলাকার লোকেরা উৎখাত হয়ে গেছে। এখানে আলী আহম্মদ নামে একজন পুরাতন বাঙালির জায়গাও ছিলো।
আংক্ষ্যং আফ্যা গ্রাম থেকে যারা উচ্ছেদ হয়েছেন তারা হলেন- ১. উসাচিং মারমা, ২. অংসাচিং মারমা, ৩. অংসিংউ মারমা, ৪. উক্যজাই মারমা, ৫. অংশৈ মারমা, ৬. মেদু মারমা, ৭. মেফ মারমা,৮. চাইংশেউ মারমা, ৯. উচিংহ্লা মারমা ও ১০. মেছিঅং মারমা।
মংনুচিং মারমা প্রতিনিধি দলকে আরো বলেন, আংক্ষ্যং এলাকায় পড়ে থাকা জমি আমরা আবাদ করে খেতাম। বর্তমানে তা অনাবাদী রয়েছে। আমাদের মোট ৪০ একরের অধিক জায়গা ছিলো বলে তিনি জানান। এ সময় তিনি তার নিজস্ব কর্তৃক রোপনকৃত আম ও কাঠাল গাছ প্রতিনিধি দলকে দেখান। বর্তমানে সেখানে সেটলার বাঙালি দুই পরিবার বসবাস করছে। বৌদ্ধমন্দিরের ভিটা ছাড়া আর কোন চিহ্ন চোখে পড়েনি।
আংক্ষ্যং ওয়া(সাপমারা ঝিড়ি নীচ) এর বাসিন্দা ফোঅং মারমা (কার্বারী) বয়স: ৪৫ বছর। তিনি প্রতিনিধি দলকে বলেন, এখানকার লোকেরা ব্রিটিশ আমল থেকে বসবাস করে আসছি। এখানে আমরা জুমচাষ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে চলেছি। বর্তমানে জায়গাগুলো দখল হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা জুমচাষ করতে পারছি না। আমাদেরকে নিজ জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে জায়গা দখল করার জন্য দলীয় ও কোম্পনীর লোকেরা বিভিন্ন ডাকাত বাহিনীকে পৃষ্টপোষকতা করে থাকে। এর ম্যাধমে তারা পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের উপর অন্যায় অত্যাচার চালায় এবং জায়গাগুলো ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে।
তিনি আরো বলেন, আমরা দিনের বেলায় এখানে অবস্থান করি কিন্তু রাতে এখানে থাকি না। আমাকে অনেকবার ডাকাতরা ফোন করেছে এবং টাকা বিকাশ করে দিতে বলেছে। কিন্তু আমি তাদের উপেক্ষা করে চলার চেষ্টা করছি। একবার আমার বাড়িতে ডকাতরা হামলা চালায় এবং আমাকে মারধর করে। আমার পিঠের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছিলো। তার পর থেকে আমি এবং আমার পরিবার রাতে বাড়িতে অবস্থান করি না। আমরা বৈংমত পাড়ায় চলে যাই। ডাকাতরা উচ্ছেদ হওয়া পরিবারে জায়গা দখল করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আমি আলম মাঝিকে বলিরযে কে এই এলাকা দখল করে আমি দেখবো। আমার হুমকির কারণে তারা আমার জায়গা দখল করতে পারছে না এবং আমার এলাকার পাশে জায়গা দখল করতে পরছেনা।
এই গ্রাম থেকে ইতিমধ্যে যারা উচ্ছেদ হয়েছেন তারা হলেন- ১. উসিংমং মারমা(৪৫), ২. উক্যসিং মারমা (৩৫), ৩. মংহ্লাপ্রু মারমা (৪০), ৪. খ্যাকাহ্ন মারমা (৪২), ৫. উমংচিং মারমা (৫০), ৬. হ্লাসিংনু মারমা (৪০), ৭. হ্লামং মারমা (৭০), ৮. মোসাপ্রু মারমা (৭৩)
প্রতিনিধি দলের দলের নেতৃবৃন্দ জানান, সেখানে বর্তমানে ডজনের অধিক নামে বেনামে বিভিন্ন কোম্পানী রাবার বাগান করছে এবং অনেক অর্থবিত্তের মালিকরা নতুন নতুন রাবার বাগান করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকা পরিদর্শনকালে যেসব কোম্পানীর নাম জানা গেছে সেগুলো হলো: ১.নাজমা খাতুন হোমল্যান্ড রাবার কোম্পনী লিমিটেড(পরবর্তিতে নাজমা খাতুন) ২.পিএচপি কোম্পানী (মিজানুর রহমান), ৩.কাবলী এ এইচ রবার বাগান, ৪. ইলিয়াস কোম্পানী, ৫. এএইচপি কোম্পানী, ৭. মোহম্মদ আমিন ইলিয়ান কোম্পানী, ৮.মোহাম্মদ আলম মাঝি, ৯.নাজিমুদ্দিন প্রফেসর কোম্পানী, ১০.ফারুক হোসেন কোম্পানী, ১১. নেশ্যানাল রাবার বাগান ইন্ডাস্ট্রি, ১২.অলিম উদ্দিন কোম্পানী, ১৩. ইলিয়াস কোম্পানী ইত্যাদি।
যেভাবে রাবার বাগান সৃজন করা হয়
প্রথমে জলিল ও সজল সাহেব এর তত্ত্বাবধানে নতুন চাক পাড়া এবং কাবলী হোসেন এর তত্বাবধানে এএইচ কোম্পনী এবং প্রফেসার মিজানুর রহমান এর পিএইচপি কোম্পানী সেখানে প্রথম বাগান সৃজন করে। বর্তমানে রাবার বাগান করার পরিধি যে মাত্রায় বেড়েছে তাতে পরিবেশের মারাত্মক হুমকি ও ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
মোহাম্মদ আলম মাঝির নেতৃত্বে ২০০৭ সালের জরুরী অবস্থার পর থেকে প্রায় ৪০০-৫০০ একর পাহাড়ি জায়গা বেদখল করা হয়েছে। জায়গা বেদখল করার পর তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে জায়গা ভাগ করে দিয়েছেন চড়া মূল্যে। তিনি মাঝি থেকে এখন বিরাট কোটিপতি বনে গেছেন।
পিএইচপি কোম্পানী ও অন্যান্য রাবার কোম্পানী সমূহ
২৮৩ নং ঈদগাহ মৌজা এলাকায় ১০ টি প্লটে মোট ২৫০ একর জায়গা রয়েছে। কিন্তু এখানে ঈদগাহ মৌজা এলকার হেডম্যান এর সাথে যোগ সাজশ করে সরকারী কর ফাঁকি দিয়ে তারা প্রায় ৫০০ একরের অধিক জায়গায় বাগান করছে। এছাড়া ২৭৮ নং বাইশারী মৌজায় পিএইচপি কোম্পানী ১১ নং প্লটে মোট ৪০ একরের অধিক জায়গায় রাবার বাগান করছে। ২০০৮ সালের দিকে নাজমা হোমল্যন্ড রাবার বাগান শ্রমিক ইউনিয়েনের নেতা মংহ্লা মারমা নেতৃত্বে শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে শ্রম আদালতে মামলা চলে এবং এক পর্যায়ে কোম্পনী কারচুপি করে নাম পরিবর্তন করে। কিন্তু শ্রম আদালত শ্রমিকদের পক্ষে রায় দেয়। শ্রমিকদের পাওনা চুকিয়ে দিয়ে নাজমা হোমল্যান্ড এর নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে রাখা হয়েছে নাজমা খাতুন রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ।
বৈয়ংমদঅং পাড়ার বাসিন্দা জেএসএস এর সাবেক সভাপতি নিলামং মারমার রেকর্ডকৃত জায়গা নাজমা খাতুন হোমল্যান্ড কোম্পনী শুরুর দিকে দখল করে নিয়েছে বলে এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন।
মোট কথা, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সহ বান্দরবানে যে হারে রবার বাগান করা হচ্ছে তাতে বান্দরবানের মোট বনভুমির ৫০ শতাংশ জায়গা জুড়ে রবার বাগান করা হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানী এবং ব্যক্তিগতভাবে। এছাড়া মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গা নিজস্ব ভিটামাটি এবং ২০ শতাংশ জায়গা কৃষি জমির আওতায় রয়েছে। অতিমাত্রায় রাবার বাগান সৃজনের ফলে এলাকায় বৃষ্টির পরিমান কমে গেছে এবং তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি হওয়ার পরও তীব্র গরম সর্বদা বিরজমান রয়েছে। অন্যদিকে, সহজ সরল পাহাড়িরা নিজ জায়গা-জমি ও বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে। তাই, প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা ও ভূমিদস্যু কর্তৃক পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করার জন্য সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
————-
সিএইচটিনিউজ.কম’র প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিলে যথাযথ সূত্র উল্লেখপূর্বক ব্যবহার করুন।